ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

এমপি আজীম এক সপ্তাহের বেশি নিখোঁজ থাকায় রহস্য ঘনীভূত

সিসিটিভি ফুটেজে এমপির সঙ্গী দুই বাংলাদেশি কারা

পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লিতে গিয়ে খুঁজছেন স্বজন

সিসিটিভি ফুটেজে এমপির সঙ্গী দুই বাংলাদেশি কারা

এমপি আজীম

 সাহাদাত হোসেন পরশ

প্রকাশ: ২২ মে ২০২৪ | ০১:১০ | আপডেট: ২২ মে ২০২৪ | ১১:১০

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য মো. আনোয়ারুল আজীম (আনার) ভারতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়ার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। স্বজনরা পশ্চিমবঙ্গ ও দিল্লিতে গিয়ে হন্যে হয়ে তাঁকে খুঁজছেন। কিন্তু তাঁর অবস্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য মিলছে না।

বাংলাদেশের একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এমপি আজীম একা ভারতে গেছেন বলে শুরু থেকে প্রচার করা হলেও আসলে তাঁর সঙ্গে আরও দু’জন ছিলেন। তারাও বাংলাদেশি বলে এখন পর্যন্ত তথ্য মিলেছে। সিসিটিভি ক্যামেরার কিছু ফুটেজে ভারতীয় গোয়েন্দারা এমন তথ্য পেয়েছেন। ওই দুই ব্যক্তির নাম-পরিচয় সম্পর্কে জানতে চাইলে সূত্রটি সমকালকে জানায়, দু’জনই এমপি আজীমের দীর্ঘদিনের পরিচিত। তাদের বাড়ি এমপির এলাকায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ওই দু’জনের বর্তমান অবস্থান সম্পর্কে অবশ্য ভিন্ন তথ্য পাওয়া গেছে। একটি সূত্র বলছে, আজীম ভারতে যাওয়ার কয়েক দিন পর ওই দু’জন দেশে ফিরেছেন। আরেকটি সূত্র বলছে, তারা ভারতে রয়েছেন। দেশটির আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে।

এদিকে এমপি আজীমকে নিয়ে শঙ্কা বাড়ছে। তিনি জীবিত, নাকি মৃত– সেই প্রশ্ন উঠছে। চোরাচালান বা অন্য কোনো অবৈধ কারবার নিয়ে বিরোধের জেরে তিনি ফাঁদে পড়েছেন কিনা– সেই আলোচনাও হচ্ছে। ভারতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে, এমন আলোচনাও রয়েছে। 

এমপি আজীমের পিএস আবদুর রউফ গতকাল মঙ্গলবার সমকালকে বলেন, ‘আমরা এখনও খোঁজ পাইনি। একেকজন একেক কথা বলছে। কেউ বলছে, পুলিশ হেফাজতে আছে। আবার কেউ বলছে, ফাঁদে পড়েছেন। আসলে কী ঘটেছে বুঝতে পারছি না।’ রউফ আরও বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে একটি গাড়ি জব্দ ও চালককে আটক করা হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, গাড়িটি এমপি ব্যবহার করেছেন। যে পুলিশ স্টেশনে তারা রয়েছেন, সেখানে আমাদের লোকজন গিয়েছিলেন; কিন্তু আটক চালকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেননি। পুলিশ বলেছে, তাদের কাছে স্পষ্ট বলার মতো কোনো তথ্য নেই। দিল্লিতেও আমাদের লোকজন গিয়ে খোঁজখবর নিচ্ছেন। ভিসা পেলে এমপির মেয়ে ও আমি দ্রুত ভারতে যাব।’

এ ব্যাপারে ভারতের গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশের দু’জন পদস্থ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। সমকালকে তারা বলেন, ‘সেখানে সিসি ক্যামেরার একটি ফুটেজ পাওয়ার কথা জানা গেছে। সেই ফুটেজে এমপি আজীমের সঙ্গে দুই ব্যক্তিকে দেখা গেছে।’

এমপি আজীমের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি কারবার, মাদক ও নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এক সময় তাঁর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের রেড নোটিশ ছিল। তাই এপার-ওপারের চোরাচালানকেন্দ্রিক বিরোধের জেরে তিনি কোনো ফাঁদে পড়েছেন কিনা, তা নিয়ে তদন্ত চলছে।

তবে এমন আলোচনাও রয়েছে– ভারতের অর্থনৈতিক গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট অব ডিরেক্টরেটের (ইডি) জেরার মুখে পড়েছেন এমপি আজীম। ওই জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তিনি ছাড়া পেতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, গত চার-পাঁচ দিনে এমপি আজীমের মোবাইল ফোন দু’বার সচল হয়। আসাম ও উত্তরপ্রদেশে এগুলোর অবস্থান দেখা গেছে। এর আগে বেনাপোল সীমান্তের কাছাকাছি ও মোজাফফরাবাদে তাঁর ফোনের অবস্থান দেখায়।

গত ১২ মে এমপি আজীম চিকিৎসার জন্য ভারতে যান। ওই দিন সকালে নিজের গাড়িতে তিনি একাই দর্শনার উদ্দেশে রওনা হন। বেলা ১১টার দিকে তিনি দর্শনা চেকপোস্ট পার হয়ে ভারতের গেদে স্টেশনে প্রবেশ করেন। সেখানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে অল্প সময়ের মধ্যে ওপারের একটি ইঞ্জিনচালিত রিকশায় রওনা হন। এ সময় তাঁর সঙ্গে একটি লাগেজ ছিল। তিনি চলে যাওয়ার পর চালক তরিকুল ইসলাম গাড়ি নিয়ে কালীগঞ্জে ফেরেন।

এরপর ১৮ মে কলকাতার বরাহনগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন গোপাল বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি। তিনি মূলত স্বর্ণ কারবারি। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, আজীমের সঙ্গে তাঁর ২৫ বছরের পারিবারিক সম্পর্ক। ১২ মে সন্ধ্যা ৭টার দিকে আজীম তাঁর কলকাতার মণ্ডলপাড়া লেনের বাড়িতে আসেন। তিনি কলকাতায় এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। পরদিন দুপুর পৌনে ২টার দিকে ডাক্তার দেখানোর জন্য সেখান থেকে বের হন আজীম। যাওয়ার সময় তিনি (আজীম) বলে যান, দুপুরে খাবেন না। সন্ধ্যায় ফিরবেন। পরে তিনি কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে এসে গাড়ি ডেকে দিয়ে চলে যান। জিডির তথ্য অনুযায়ী, সন্ধ্যায় গোপালের বাসায় ফেরেননি আজীম। হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে গোপালকে একটি বার্তা পাঠিয়ে জানানো হয়, বিশেষ কাজে তিনি দিল্লি যাচ্ছেন। ১৫ মে আজীমের নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে আরেকটি বার্তা আসে। তাতে তিনি দিল্লি পৌঁছার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার সঙ্গে ভিআইপিরা আছেন, ফোন করার দরকার নেই।’ 

গতকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশ ও ভারতের ইমিগ্রেশন পার হয়ে যথাযথভাবেই এমপি আজীম ভারতে যান। পরিবার থেকে জানানো হয়েছে, তাঁর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারি সব সংস্থা এটি নিয়ে কাজ করছে। আমাদের এনএসআই, এসবি ও পুলিশ কাজ করছে। ভারতীয় পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনও কাজ করছে। আশা করছি, ভারত সরকারের মাধ্যমে শিগগির তাঁর বিষয়ে জানতে পারব।’

এদিকে পশ্চিমবঙ্গের বারাকপুর দক্ষিণের পুলিশের উপকমিশনার অনুপম সিং গতকাল সাংবাদিকদের জানান, আনোয়ারুল আজীমের বিষয়ে এখনও কিছু জানতে পারেননি।
সমকালের কালীগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, এমপি আজীমের খোঁজে দলীয় কার্যালয়ে ভিড় জমাচ্ছেন দলের নেতাকর্মীরা। কালীগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, ‘এক সপ্তাহ পার হয়ে গেছে, তাঁর কোনো সন্ধান নেই। ভারত বড় দেশ।  তিনি কোনো বিপদে আছেন কিনা বুঝতে পারছি না। আমরা সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি, যেন দ্রুত তাঁকে খুঁজে আনা হয়।’
 

আরও পড়ুন

×