বিশ্ব মরুময়তা দিবস আজ
অনাবৃষ্টি-খরায় সংকটে কৃষি

ছবি: সংগৃহীত
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ জুন ২০২৪ | ১০:১৯ | আপডেট: ১৭ জুন ২০২৪ | ১০:৫২
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং খরার কারণে সবুজ পৃথিবী ক্রমে মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মরুকরণ বাংলাদেশে প্রকট আকার ধারণ করছে। দেশের অর্থনীতি, কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তা, জ্বালানি, জীববৈচিত্র্য, স্বাস্থ্য, সুপেয় পানি ও উপকূলবর্তী এলাকার ওপর এই প্রভাব গুরুতরভাবে পড়ছে। গ্রীষ্মকালে তাপপ্রবাহ দুর্বিষহ অবস্থা সৃষ্টি করছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও মরুকরণের কারণে পানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে, যা কৃষির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, ফসলের উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা খাদ্য সংকটের অনেক বড় কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব মরুকরণ ও খরা প্রতিরোধ দিবস। গত ২৭ বছর ধরে প্রতি বছর এই তারিখে দেশেও দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশে প্রথম বিশ্ব মরুময়তা দিবস পালিত হয়। উত্তরাঞ্চলের রাজশাহীকে কেন্দ্রবিন্দু ধরে নগর থেকে ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমে কাকনহাটে জাতীয়ভাবে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালিত হয়। ১৯৭৫ সালে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘের পক্ষ থেকে খরা ও মরুকরণের প্রতি সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। এই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৭ সালে নাইরোবিতে বিশ্ব মরুকরণ বিরোধী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের পরিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্মেলনের পরপরই মরুকরণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক কনভেনশন গ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
রিও সম্মেলনের এজেন্ডা ২১ এর প্রস্তাবটি ১৯৯২ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৪৭তম অধিবেশনে গৃহীত হয় এবং ইন্টারগভর্মেন্টাল নেগোশিয়েটিং কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি মরুকরণ সংক্রান্ত খসড়া কনভেনশন চূড়ান্ত করে। ১৯৯৪ সালের জুন মাসে কনভেনশনের দলিল চূড়ান্ত হয়। এই কনভেনশনে ৫০টি দেশ কর্তৃক অনুমোদিত হওয়ার পর ১৯৯৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যকর হয়। বাংলাদেশও এই কনভেনশন অনুমোদন করে। পরবর্তী সময়ে খরা ও মরুকরণ সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করে তুলতে ১৭ জুন পালন করা হয় বিশ্ব খরা ও মরুকরণ প্রতিরোধ দিবস।
বাংলাদেশ মেটেরিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টের (বিএমডি) রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশের গড় তাপমাত্রা গত ৫০ বছরে প্রায় ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। গড় তাপমাত্রা পরিবর্তন হওয়ায় বৃষ্টিপাতের ধরন ও সময় বদলে গেছে। এখন আর প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে যথা সময়ে ঋতুর আবির্ভাব ঘটছে না এবং ঋতুর সংখ্যাও হ্রাস পেয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রিজিলিয়ানস সেন্টারের ‘হট সিটিস, চিলড ইকোনমিস: ইমপ্যাক্টস অব এক্সট্রিম হিট অন গ্লোবাল সিটিস’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয় যে ঢাকায় উচ্চ তাপমাত্রার কারণে প্রতিবছর ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতি হচ্ছে এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই ক্ষতির পরিমাণ ৮ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের রিপোর্ট অনুযায়ী, খরার কারণে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন প্রায় ২০-৩০ শতাংশ কমে গেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই এলাকাগুলোতে মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষি উৎপাদনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। যথেচ্ছভাবে বৃক্ষ নিধনের ফলে স্থানীয় আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটছে এবং মাটির উপরিভাগ আলগা হয়ে বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে। খরার ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়, আবহাওয়ার তাপমাত্রা ও বায়ুর গতি পরিবর্তিত হয় এবং এতে মরুকরণ ত্বরান্বিত হয়। খরার কারণে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ফলে সুপেয় পানি সরবরাহের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের বরেন্দ্র অঞ্চল নামে খ্যাত নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের আবহাওয়ায় মরুময়তার লক্ষণ স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় পরিচালিত ২০২০ সালের জরিপ অনুযায়ী, দেশে মোট নদীর মধ্যে মৃত ও মৃতপ্রায় নদীর সংখ্যা প্রায় ১৪০টি। ভূমির মরুতে রূপান্তরের প্রধান কারণ হলো বনভূমির নিধন। খরা ও মরুকরণের কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পানির স্তর বছরে গড়ে স্থানভেদে দুই থেকে তিন ফুট করে নিচে নেমে যাচ্ছে এবং এই হার অব্যাহত থাকলে আগামী ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে এ দেশের উত্তরাঞ্চল সম্পূর্ণ মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে।
তাপপ্রবাহ, খরা এবং মরুকরণ নিয়ে এখন আগের থেকে অনেক বেশি গবেষণা চলছে। একাধিক বিজ্ঞানী ও সংস্থা এই সমস্যাগুলোর সমাধান নিয়ে কাজ করছে। নাসার গবেষণায় দেখা গেছে, যদি বর্তমান খরা পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে তবে ২১ শতকের শেষ নাগাদ বিশ্বব্যাপী খরার তীব্রতা প্রায় ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
ঢাকা শহরের ৩৬টি স্থান নিয়ে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)–এর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় উত্তরা সেক্টর-১৩ এলাকায় এবং সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় নয়াপল্টন এলাকায় ৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ শুধু জলাভূমি ও বৃক্ষ কম থাকার কারণে উত্তরা সেক্টর-১৩ এলাকা এবং নয়াপল্টন এলাকার মধ্যকার গড় তাপমাত্রার পার্থক্য ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
ক্যাপসের গবেষণা থেকে আরও পরিলক্ষিত হয়— যেসব এলাকায় সবুজের উপস্থিতি রয়েছে, সেসব এলাকায় তাপমাত্রা তুলনামূলক কম এবং গাছপালা ও জলাভূমি কম থাকার কারণে বাণিজ্যিক এলাকাগুলোতে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। ক্যাপসের গবেষণায় আরও দেখা যায় যে ২০১৭ সালের গড় তাপমাত্রার তুলনায় ২০২৪ সালের গড় তাপমাত্রা প্রায় ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়েছে। মরুকরণের ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আবার এই তাপমাত্রা বৃদ্ধিই মরুকরণকে ত্বরান্বিত করছে।
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন, খরা ও মানুষের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ফলে উর্বর ভূমির ধীরে ধীরে মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়াই হচ্ছে মরুকরণ। ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রায় ১৭% এলাকা সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। তিনি ঢাকার দক্ষিণ ও উত্তর কর্পোরেশন সিটির জলাশয় ও বৃক্ষ নিয়ে তুলনামূলক তথ্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ১৩-১৪ টা জেলায় খরা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ফলে ২০-৩০% ফসলের উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আগামী ২০-২৫ বছরে উত্তরাঞ্চলে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, এসব এলাকা মরুভূমির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠে। এই ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা, খরা ও মরুময়তা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সর্বপ্রথম যে পদক্ষেপ নিতে হবে তা হল প্রচুর পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করতে হবে এবং বনায়ন কার্যক্রম বাড়াতে হবে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, কৃষি হতে হবে কৃষকবান্ধব। প্রান্তিক কৃষকদের বাঁচাতে পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ভূমির দূষণ নিয়ন্ত্রণ, উর্বরতা বৃদ্ধি, মরুময়তা রোধ করা এবং জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত বিরূপ প্রভাব থেকে মুক্ত করার মাধ্যমে ভূমির সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে হবে। আগামী ৫০ বছর পর কি প্রভাব পড়তে পারে তা বিশ্লেষণ করে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. আব্দুল হামিদ বলেন, আমাদের ভূমি, আমাদের ভবিষ্যৎ। বৈশ্বিক অবস্থা বিবেচনায় রেখে আমরা খরা মোকাবিলা করছি। আমাদের ফ্লোটিং অ্যাগ্রিকালচার অনেক দেশে অনুসরণ করছে। তবে জলবায়ুর প্রভাবে কৃষিকে আরও টেকসই করার সুযোগ রয়েছে।