খামারবাড়িতে কর্মকর্তাদের খুনি আখ্যা দিয়ে টানানো হয়েছে ছবি

কর্মকর্তাদের খুনি আখ্যা দিয়ে টানানো হয়েছে ছবি
জাহিদুর রহমান
প্রকাশ: ০৪ নভেম্বর ২০২৪ | ২২:১৩
কৃষির বাতিঘর খ্যাত রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরে (ডিএই) অস্থিরতা থামছেই না। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে চেয়ার দখলে মরিয়া হয়ে উঠেছেন বিএনপিপন্থি কর্মকর্তারা। অনেকে চাপ প্রয়োগ করে গুরুত্বপূর্ণ চেয়ারে তাদের পোস্টিং বাগিয়ে নিচ্ছেন। পদোন্নতি বঞ্চনা ও হয়রানির অভিযোগ এনে একেক সময় একেক রকম কর্মসূচিতে কৃষির সবচেয়ে বড় এই সংস্থাটিতে আতঙ্ক বিরাজ করছে। চেয়ার দখলের দৌড়ে এগিয়ে থাকতে গুনতে হচ্ছে টাকাও। পদায়ন বাণিজ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের নামে চলছে চাঁদাবাজি। টেন্ডার ভাগিয়ে নিতেও চলছে হুমকি-ধমকি। এমন অস্থির পরিস্থিতিতে খামারবাড়ির কার্যক্রমে নেমে এসেছে স্থবিরতা।
জানা গেছে, গত তিন মাসে আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের সরিয়ে গুরুত্বপূর্ণপদে বিএনপি ও জামাতপন্থীদের পদায়ন হয়েছে। শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, খালি হওয়া পদে বসতে একটি চক্রকে মোটা অংকের টাকা দিতে হচ্ছে। তবে এখনও অধিকাংশ প্রকল্প পরিচালক (পিডি) বহাল আছেন। আর বড় প্রকল্পগুলোর পিডি হতে মরিয়া হয়ে ওঠেছেন বিএনপিপন্থি একদল কর্মকর্তা। তারা প্রকল্পের বর্তমান পিডি ও ডিপিডিদের সরাতে অনেকদিন ধরে তৎপর আছেন। সর্বশেষ প্রকল্প পরিচালকদের বদলির একটি তালিকা তারা কৃষি মন্ত্রণালয়ের পাঠান। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে সোমবার প্রকল্প পরিচালকদের ছাত্র খুনের সঙ্গে জড়িত বলে ছবিসহ বড় ব্যানার খামারবাড়ির সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত চাপ তৈরি করে পিডিদের চেয়ার ছাড়তে বাধ্য করতেই এই পন্থা নেওয়া হয়েছে।
আজ সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ডিএইর প্রবেশমুখেই দুটি বিশাল আকারের ব্যানার ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ব্যানারে সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক, ডিএইর সাবেক দুইজন মহাপরিচালকসহ ৩৯ জনের ছবি দিয়ে ছাত্র হত্যার দায়ে তাদের শাস্তি দাবি করা হয়েছে। এতে তুলনামূলক বড় প্রকল্পের পিডি, ডিপিডি ও গুরুত্বপূর্ণ পদের কর্মকর্তারা ঠাঁই পেয়েছেন। এ ছাড়া এক প্রকল্প পরিচালকের স্ত্রীর ছবিসহ লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে। তবে ব্যানারে সাবেক সংসদ সদস্য কৃষিবিদ বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাবেক কৃষি সচিব ওয়াহিদা আক্তারসহ ছাত্র আন্দোলন দমাতে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া বহু কর্মকর্তার ছবি নেই। এছাড়া যেসব আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বদলি হয়ে গেছেন তাদের নামও ব্যানারে নেই। ব্যানারে ছবি থাকা কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাদের মধ্যে এখন আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সকালে অফিসে গিয়ে ব্যানারে নিজের ছবি দেখে আতঙ্কে বাসায় ফিরে গেছেন বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা।
ডিএইর কয়েকজন কর্মকর্তার অভিযোগ করে বলেন, বিগত সরকারের সুবিধাভোগী কয়েকজন পিডির নাম ও ছবি ব্যানারে আসেনি। তাদের কেউ কেউ রাজনৈতিক পরিচয় বদল করেছেন। আবার অনেকেই বিএনপিপন্থিদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন।
ব্যানারে ছবি রয়েছে এমন এক প্রকল্প পরিচালক নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, সরকারি চাকরি করি, আমার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। সরকার যখন যে নির্দেশনা দেয় তা পালন করি। সরকার যেখানে বদলি করবে সেখানে যাবো। কিন্তু খুনি আখ্যা দিয়ে দেয়ালে ছবি টানানোর ঘটনায় আতঙ্কে আছি। যেকোনো মুহূর্তে হামলার শিকার হতে পারি। খামারবাড়ির বিএনপিপন্থি কর্মকর্তারাই এই কাজ করেছেন। কৃষির ইতিহাসে এমন ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক কর্মকর্তা বলেন, সরকার পতনের পর থেকে ডিএইতে ব্যাপক চাঁদাবাজি হচ্ছে। খালি হওয়া পদগুলোতে পদায়নের জন্য কেআইবির কিছু নেতা, শেরেবাংলা কৃষি বিদ্যালয়ের (শেকৃবি) ছাত্রদলের কয়েকজন এবং ডিএইর বিএনপিপন্থি কয়েকজ কর্মকর্তা মোটা অংকের টাকা নিচ্ছেন। দুর্গাপূজার নাম করে সব কর্মকর্তার কাছ থেকে চাঁদা তোলা হয়েছে। যে কোনো অনুষ্ঠান ঘিরেই তোলা হয় টাকা। আর টেন্ডারকে ঘিরে প্রকল্প পরিচালকদের নিয়মিত হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন।
জানা যায়, ডিএইতে বর্তমানে ৩২টি প্রকল্প চলমান আছে। শতাধিক কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এরমধ্যে একডজন প্রকল্পের পরিচালক বদলের জন্য মন্ত্রণালয়ে তালিকাও পাঠানো হয়েছে। তা বাস্তবায়ন না হওয়ায় নতুন করে খসড়া তালিকা করা হচ্ছে। ডিএইতে গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি ও পদায়নে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিএনপিপন্থি কয়েকজন কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে ডিএইর প্রশাসন ও অর্থ উইংয়ের উপপরিচালক ড. মুহাম্মদ মাহবুবুর রশীদ বলেন, কর্মকর্তাদের ছবি কারা টানিয়েছে তা আমার জানা নেই। আমি এ রকম কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করি না। তবে যাদের ছবি টানানো হয়েছে তারা ৪ আগস্ট ছাত্র বিরোধী সমাবেশে অংশ নিয়েছেন।
মন্ত্রী-সচিবের নির্দেশে কয়েকশ কর্মকর্তা সমাবেশে অংশ নিলেও গুটিকয়েকজনের ছবি কেন টানানো হলো এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে সবার ছবি আসেনি। আরও অনেকের ছবি আসা উচিত ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ছবি দেওয়া হয়েছে। তবে এই ছবি নামিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মহাপরিচালকসহ আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম সোমবার রাতে সমকালকে বলেন, সরকারি চাকরিতে বদলি কিংবা পদায়ন নিয়ম মেনে করা হয়। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে খুনি আখ্যা দিয়ে ছবি টানিয়ে হেয় প্রতিপন্ন করা অন্যায়। ব্যানার সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে মঙ্গলবার অফিস চলাকালীন ব্যবস্থা নেব।
- বিষয় :
- খামারবাড়ি