বিশেষজ্ঞ মত
পাল্টেছে অপরাধের ধরন, প্রতিকারে নতুন ভাবনা প্রয়োজন

ড. তৌহিদুল হক
ড. তৌহিদুল হক
প্রকাশ: ১৮ নভেম্বর ২০২৪ | ০১:১২
নাগরিকের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করতে হলে সবার সম্পৃক্ততা প্রয়োজন। সেই প্রয়োজনে নেতৃত্বে থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পুলিশসহ বিভিন্ন ইউনিট সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ সাপেক্ষে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার প্রশ্নে পেশাদারিত্বমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রাখবে। এই প্রত্যাশা যত বেশি বাস্তবায়িত হবে, তত বেশি নাগরিকের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় কেটে যাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার প্রশ্নে ঘাটতিগুলো পূরণ করে ‘স্বাভাবিক’ অবস্থা সৃষ্টিতে পুলিশের তৎপরতা ও গৃহীত উদ্যোগ আগের তুলনায় ‘অগ্রগতি’ নিশ্চিত করতে পারলেও তা জনমনে স্বস্তি সৃষ্টি করতে পারছে না। কারণ, গত দুই মাসে রাজধানীতে ৬৮ জন হত্যা বা খুনের শিকার হয়েছে। চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ, মাদক বাণিজ্য, আধিপত্য বিস্তারে সংঘাত-সংঘর্ষ, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণে হাতবদল ও অপরাধের নতুন উদাহরণ মানুষের মনে নিরাপত্তা-ভীতি ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রতিদিনের সংবাদে অপরাধের চিত্রগুলো মানুষকে বসবাস ও চলাচলে ভয়ার্ত পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয় এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনি ব্যবস্থার প্রয়োগ-সংক্রান্ত ঘাটতিও মানুষকে স্বস্তি বা আশ্বস্ত করতে পারছে না।
রাজধানীসহ দেশের অনেক স্থানে শিশু হত্যা, অপহরণ বা চুরি, পরিবারে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা বা অস্থিরতা থেকে আত্মহত্যা, রাজনৈতিক ক্যারিক্যাচারে সৃষ্ট বিভেদ-সংঘাতসহ অপরাধের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট প্রত্যাশিত উদাহরণ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। জনগণ নিজেকে ভালো রাখার জন্য কী করবে–এ ভাবনায় অস্থির বা উদগ্রীব। নিরাপত্তা বোধের সব অবয়ব পর্যালোচনা এই সাক্ষ্য দেয় যে, সকলে সকলের কাছে নিরাপদ না হওয়া পর্যন্ত কেউই কারও কাছে নিরাপদ নয়। নাগরিক নিরাপত্তার এই অমোঘ সত্য দ্বারা বাংলাদেশের মানুষ আজ বড় বেশি প্রভাবিত, চিন্তিত এবং উপায় অন্বেষণে ভাবিত। নিরাপত্তার ঘাটতি মানে সব প্রশ্নে, সব অবস্থানে সংশয়ের পাল্লা ভারী।
বর্তমান পরিস্থিতি উপলব্ধি সাপেক্ষে নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্নে মোটাদাগে কতগুলো বিষয় স্বস্তিদায়ক নয়। বাংলাদেশে অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীকে আইনের মুখোমুখি করার ক্ষেত্রে পেশাগত প্রক্রিয়ায় সব প্রয়োজন পূরণ হচ্ছে না। এটা অতীতেও হয়নি, বর্তমানেও হচ্ছে না এবং ব্যবস্থার বদল না হলে ভবিষ্যতেও হবে না। করণীয় হলো, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পেশাদারিত্বমূলক ব্যবস্থার পাশাপাশি পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘ব্যবস্থা’ গ্রহণে তৎপর হতে হবে। এই ব্যবস্থা পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অতীতে গ্রহণ করেছে। কিন্তু বর্তমানে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া বা সমালোচনার ভয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘অতিসতর্ক নীতি’ অবলম্বন করছে। বাংলাদেশে অপরাধের ধরন, অপরাধীদের দৌরাত্ম্য, অপরাধ নিয়ন্ত্রণকারীদের কারও কারও সঙ্গে অপরাধীর সখ্য বিবেচনায় আইন একমাত্র সমাধানের ব্যবস্থাপত্র হিসেবে বিবেচ্য হতে পারছে না। এ দায়-সংক্রান্ত আলোচনার সূত্র অনেক গভীরে, যা সংস্কারের মধ্য দিয়ে শোধিত হবে। তবে পেশাদারিত্বমূলক নজর নিয়ে দায়-দায়িত্ব গ্রহণসাপেক্ষে জোরালো ভূমিকা ছাড়া পরিস্থিতি পূর্ণ স্বাভাবিক করা সময়সাপেক্ষ বিষয়।
অন্যদিকে, পরিবার বা আবাসস্থলকেন্দ্রিক অপরাধ বা সম্পর্ক-সংক্রান্ত অস্থিরতা বা অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে সতর্ক হয়ে চলতে হবে। জেনে রাখা প্রয়োজন, অতীতে অপরাধীরা মানুষ থেকে দূরে থাকত, অপরাধ করে পালিয়ে বেড়াত। এখন সময়ের পরিবর্তন, দৃষ্টিকোণ ও প্রযুক্তিগত প্রক্রিয়ার কারণে অপরাধীরা মানুষের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বা সম্পর্ক তৈরি করে ক্ষতি করছে। মানুষ মানুষের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি বা সহমর্মিতা নিয়ে পরস্পর আস্থার ভিত্তিতে ব্যক্তিজীবন বা সমাজজীবন পরিচালিত করবে– এটাই প্রত্যশা। তবে এই প্রত্যাশায় ‘আবেগ’-এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা চাই।
সর্বোপরি, অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সামাজিক ব্যবস্থাকে সম্পৃক্ত করে কতিপয় উদ্যোগ পুলিশ গ্রহণ করলেও এগুলোর কার্যকর অনুশীলন প্রয়োজন। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ‘সক্রিয় নাগরিক’ ধারণা বোধ যত বেশি সৃষ্টি হবে, নাগরিকরা সার্বিক অবস্থাকে নিজের মনে করে দায় নিয়ে দায়িত্ব পালনে তত বেশি অনুপ্রাণিত হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ, সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
- বিষয় :
- অপরাধ