৪০ হাজার বিদেশির অবৈধ বাস, মশগুল অপরাধে

কোলাজ
সাহাদাত হোসেন পরশ ও আব্দুল হামিদ
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:০৯ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১০:৪২
বন্ধুত্বের সেতু তৈরি করে দামি উপহারের ফাঁদ, অনলাইনে ক্যাসিনো কারবার, ক্রেডিট কার্ডের কেরামতিসহ বহুমাত্রিক জালিয়াতির ঘটনায় বিদেশিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনে আসে হরহামেশা। বিদেশিদের এসব চক্করে পড়ে অনেকে হচ্ছেন ফতুর।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তথ্য বলছে, শেষ ১২ বছরে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছেন ২৮ দেশের ৭৩০ নাগরিক। সবাইকে টপকে গেছে নাইজেরিয়া; সংখ্যাটা ৯১। অবৈধভাবে বাংলাদেশে থিতু হয়ে অনেক বিদেশি অপরাধে মশগুল থাকছেন। অভিযোগ আছে, অবৈধ পথে কামাইয়ের সেই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে নিজ দেশে পাচার করছেন।
কারাগার সূত্রে জানা যায়, গত সোমবার পর্যন্ত সারাদেশের ৬৮ কারাগারে চার শতাধিক বিদেশি নাগরিক বন্দি আছেন। তাদের মধ্যে সাজা পাওয়া বন্দির সংখ্যা ৭০, বিচারাধীন বন্দি দুই শতাধিক। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন ১৫০ জন।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র বলছে, অপরাধে যুক্ত হওয়ার বাইরে দেশে অবৈধভাবে অবস্থান করছেন অন্তত ৪০ হাজার বিদেশি। তাদের অধিকাংশই নাইজেরিয়া, চীন ও ভারতের নাগরিক। বাংলাদেশে বৈধভাবে রয়েছেন এমন বিদেশির সংখ্যা এক লাখের বেশি। বিদেশি নাগরিকের খোঁজখবর রাখে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)।
এসবির এক কর্মকর্তা গতকাল সমকালকে জানান, অবৈধভাবে দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকের সুনির্দিষ্ট তথ্য রাখা কঠিন। কারণ, অনেকের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হলে আবার নতুনভাবে আবেদন করেন। তখন বৈধভাবে বাস করতে থাকেন। অনেকে থাকেন ব্যবসায়িক ও ভ্রমণ ভিসায়। কেউ কেউ ‘অন অ্যারাইভাল’ ভিসায় এসে অবৈধভাবে থেকে যান।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে এসে ইচ্ছা করেই পাসপোর্ট নষ্ট করে ফেলেন। কেউ আবার ভিসার মেয়াদ শেষ হলে পাসপোর্ট ফেলে দেন বা লুকিয়ে রাখেন। আবার পাসপোর্ট হারানোর কথা বলে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার অনেক ঘটনাও আছে। এর পর জিডির সুবাদে অবৈধভাবে থাকার সুযোগ নেন। গ্রেপ্তার ও মামলার আসামি হলে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতায় তারা এ দেশে থেকে যাওয়ার সুযোগ নিচ্ছেন।
গত রোববার বড়দিন ও থার্টিফার্স্ট নাইটের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আয়োজিত সভা শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, অবৈধ বিদেশি নাগরিকদের বাংলাদেশে থাকতে দেওয়া হবে না। তাদের বিষয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে কত অবৈধ বিদেশি রয়েছেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন প্রয়োজনে অনেক বিদেশি বাংলাদেশে বাস করছেন। যারা অবৈধভাবে আছেন, তাদের কাগজপত্র ঠিক করতে একটি নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে।
২০২০ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশির মধ্যে সবচেয়ে বেশি কাজ করছেন তৈরি পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে। তাদের মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কার নাগরিক বেশি। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প, বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক এনজিও, চামড়া শিল্প, চিকিৎসাসেবা এবং হোটেল ও রেস্তোরাঁয় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বিদেশি কাজ করছেন। অবৈধভাবে বাংলাদেশে কাজ করে প্রতিবছর প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন তারা।
এদিকে, অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকের ব্যাপারে গতকাল মঙ্গলবার সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অনেক ভিনদেশি অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অবৈধভাবে কর্মরত আছেন। তাদের অবিলম্বে বাংলাদেশে অবস্থানের বা কর্মরত থাকার প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ বৈধতা অর্জনের জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। তা না হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়।
২০২০ সালে এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ১৬০ পোশাক কারখানার ওপর এক জরিপ চালিয়ে দেখেছে, সংশ্লিষ্ট কারখানাগুলোতে কর্মরত বিদেশির সংখ্যা ২ হাজার ২০০।
কারও কারও মতে, দেশে দক্ষ ব্যবস্থাপকের অভাব ও শিল্প খাতে অভিজ্ঞ জনশক্তি না থাকায় বিদেশি কর্মজীবীর সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে কাজের অনুমতি চেয়ে করা আবেদনের মধ্যে ১৬ হাজার ৩০৩টিতে অনুমোদন দেয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ সংখ্যা ছিল ১৫ হাজার ১২৮। ২০২০-২১ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৬টি।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থানরত বৈধ বিদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১ লাখ ৭ হাজার ১৬৭ জন। তাদের মধ্যে ব্যবসা ও বিনিয়োগ-সংক্রান্ত ভিসায় এসেছেন ১০ হাজার ৪৮৫ জন। চাকরির ভিসায় ১৪ হাজার ৩৯৯, শিক্ষা ভিসায় ৬ হাজার ৮২৭ ও ভ্রমণ ভিসায় এসেছেন ৭৫ হাজার ৪৫৬ জন। সবচেয়ে বেশি রয়েছেন ভারতীয় নাগরিক, ৩৭ হাজার ৪৬৪ জন। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা চীনের নাগরিক রয়েছেন ১১ হাজার ৪০৪ জন।
বিদেশি নাগরিকের অপরাধ কর্মকাণ্ডের ওপর নজর রাখেন এমন দু’জন কর্মকর্তা জানান, বিদেশিদের মধ্যে যারা যারা অপরাধে যুক্ত, তাদের বেশির ভাগই বাস করেন রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, বনানী, বারিধারা, ধানমন্ডি, নিকুঞ্জ, বনশ্রীসহ অভিজাত এলাকায়। বাড়ি ভাড়া কিংবা আবাসিক হোটেলে থেকে চালিয়ে যাচ্ছে নানা অপকর্ম। এই চক্রে নাইজেরিয়া, ঘানা, সেনেগাল, ক্যামেরুন, লাইবেরিয়া, কেনিয়া, চাঁদসহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশের অন্তত চার হাজার নাগরিক আছেন। পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, চীন ও তাইওয়ানের নাগরিকের বিরুদ্ধেও রয়েছে অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগ।
প্রথমে তারা ফেসবুকে আইডি খোলেন। এর পর বন্ধুত্ব গড়ার টোপ দেন। ই-মেইল, হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জারেও বন্ধু হিসেবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়েন। এক পর্যায়ে তারা মোটা অঙ্কের টাকার লোভ দেখান। ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনে লোভনীয় লটারি পাওয়ার মেসেজ পাঠিয়ে মূল্যবান গিফট পাঠানোর কথা বলে পার্সেল ফি আদায় করে প্রতারণা চালান। কারও কারও ক্রেডিট ও ডেবিট কার্ড এবং অনলাইন ব্যাংকিংয়ের গোপন পাসওয়ার্ড নিয়ে টাকা হাতিয়ে নেন। এর পর ওই অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা হয়।
বাংলাদেশে অবস্থান করা বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা ফৌজদারি অপরাধসহ প্রতারণায় জড়িয়েছেন। তাদের মধ্যে নাইজেরিয়া, চীন ও ভারতের নাগরিকই বেশি। ডিএমপির অপরাধ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫০টি মামলা হয়েছে। ২৩টি মামলা আদালতে বিচারাধীন। তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। বাকি ২৪ মামলা পুলিশি তদন্তাধীন। এসব মামলায় ৯০ বিদেশি এজাহারনামীয় আসামি, যাদের অধিকাংশ জামিনে রয়েছেন।
রাজধানী ঢাকায় অপরাধে জড়িয়ে পড়া নাগরিকদের মধ্যে চীনের ২২, নাইজেরিয়ার ১৯, ভারতের ১২, জাপানের চার ও ক্যামেরুনের তিনজন রয়েছেন। এ ছাড়া পাকিস্তান, ইরান, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, জ্যামাইকা, কানাডা, মালয়েশিয়া, মিসর ও অ্যাঙ্গোলার নাগরিক রয়েছেন অপরাধীর তালিকায়।
বিদেশিদের নামে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১১ জন, বিশেষ ক্ষমতা আইনে ১৩, নারী ও শিশু নির্যাতন আইনে পাঁচ, মানব পাচার আইনে দুটিসহ প্রতারণা, পর্নোগ্রাফি, মাদক ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনেও রয়েছে একাধিক মামলা। এসব মামলায় পুলিশ, রাজস্ব কর্মকর্তা ও ভুক্তভোগীরা বাদী হয়েছেন।
বাংলাদেশে বিদেশি বন্দির মধ্যে ৩৫০ জন ভারতীয়, ১০০ জন মিয়ানমারের, আটজন চীনের ও ছয়জন পাকিস্তানি। এ ছাড়া নাইজেরিয়া, বতসোয়ানা, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া ও ক্যামেরুনের নাগরিকও রয়েছেন। বন্দিদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ১৭ কারাগারে রয়েছেন ৬৮ পুরুষ ও ১৭ নারী বিদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে বতসোয়ানার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন নাগরিকও রয়েছেন।
- বিষয় :
- অপরাধ