ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা

বাবরসহ ছয়জন খালাস, সাজা কমলো পরেশের

বাবরসহ ছয়জন খালাস, সাজা কমলো পরেশের

কোলাজ

 সমকাল প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৫৮ | আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:০০

আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিএনপি নেতা লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল বুধবার এ রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আসামিদের ডেথ রেফারেন্স খারিজ করে এবং তাদের ও অন্য আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে আদালত এ রায় দেন। 

পাশাপাশি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড করা হয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া বাকি ছয় আসামির সাজা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে ১০ বছরের কারাদণ্ড। বাবরসহ অন্য আসামিরা এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ, একই ঘটনায় করা আরেক অস্ত্র মামলায় তাদের দণ্ড রয়েছে। 

২০১৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় চট্টগ্রামের বিশেষ ট্রাইব্যুনাল ১৪ আসামির সবাইকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। এর পর বিধি অনুসারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের (ডেথ রেফারেন্স) জন্য নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পরে কারাবন্দি আসামিরা আপিল করেন। 

হাইকোর্টে খালাস পেলেন যারা

লুৎফুজ্জামান বাবর ছাড়াও খালাস পাওয়া আসামির মধ্যে রয়েছেন এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক এমডি মহসিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক এ কে এম এনামুল হক, জামায়াতের সাবেক আমির প্রয়াত মতিউর রহমান নিজামী (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর হয়েছে) ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব পলাতক নুরুল আমীন। হাইকোর্ট বলেছেন, তাদের বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। যে কারণে তারা অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার অধিকারী। তাই খালাস দেওয়া হলো।

এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আব্দুর রহীমের অভিযোগ প্রমাণিত হলেও মারা যাওয়ায় তাঁর আপিল পরিসমাপ্তি করা হয়। পাশাপাশি আব্দুর রহীমের ৫ লাখ টাকা জরিমানা কমিয়ে ১০ হাজার টাকা করেন হাইকোর্ট। এর মধ্যে মতিউর রহমান নিজামী মারা যাওয়ায় তাঁর ক্ষেত্রে আপিল অকার্যকর হয়ে গেছে। 

আমৃত্যু কারাদণ্ড

এদিকে আসামি পরেশ বড়ুয়ার মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। তাঁর বিষয়ে আদালত বলেন, বিচারিক আদালতের রায়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। শুরু থেকেই তিনি পলাতক। তাঁর বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত এবং পারিপার্শ্বিকতা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় নিয়ে তাঁর সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন করা হলে ন্যায়বিচার হবে। 
তাই সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হলো।

মৃত্যুদণ্ড থেকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড

বিচারিক আদালতের রায়ে এনএসআইর সাবেক উপপরিচালক মেজর (অব.) লিয়াকত হোসেন, এনএসআইর সাবেক পরিচালক উইং কমান্ডার (অব.) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, এনএসআইর সাবেক ফিল্ড অফিসার আকবর হোসেন খান, দুই ‘চোরাকারবারি’ হাফিজুর রহমান ও দীন মোহাম্মদ এবং চোরাকারবারির সহযোগী ট্রলার মালিক হাজি আবদুস সোবহানকে মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। সেটা পরিবর্তন করে হাইকোর্ট তাদের প্রত্যেককে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণ

রায়ের পর্যক্ষেণে বলা হয়, বিচারের উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজা দেওয়া। ঘটনা যাই হোক না কেন, তদন্ত হতে হবে যথাযথ, বস্তুনিষ্ঠ ও পক্ষপাতহীন। নিরপেক্ষ তদন্তের ওপর ভিত্তি করে বিচার হতে হবে। তাই আমরা এ মামলায় বহুমাত্রিক ঘাটতি দেখছি। মামলার তদন্তে যথেষ্ট গাফিলতি ছিল। এ ক্ষেত্রে আইনের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি সঠিক সাক্ষ্য-প্রমাণও সংগ্রহ করা হয়নি। তাই কয়েকজন আসামিকে বেকসুর খালাস, কয়েকজনের সাজা কমানো এবং কয়েকজনের সাজা সংশোধন করে রায় দেওয়া হলো। 

হাইকোর্টে আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আহসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসিফ ইমরান জিসান। এ ছাড়া পলাতক আসামির পক্ষে ছিলেন রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী হাসনা বেগম। 

বাবরের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির সমকালকে বলেন, দ্বিতীয় তদন্তের ভিত্তিতে তাঁকে প্রধান আসামি করা হয়েছিল, এখন তাঁকে হাইকোর্ট খালাস দিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিকটিম। তাঁর বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ কেউ দেখাতে পারেনি। তিনি বলেন, অস্ত্র আইনে করা মামলায় চট্টগ্রাম আদালতে সব আসামির যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। সে মামলার আপিল এখনও হাইকোর্টে শুনানি হয়নি। তাই কোনো আসামি এখনই মুক্তি পাবেন না। জামায়াতের সাবেক আমিরের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, আমরা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে ছিলাম। তিনি মারা যাওয়ায় মামলাটি অ্যাবেটেড (পরিসমাপ্তি) হয়ে গেছে।

আসামিদের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, মামলার শুরু থেকে আদালতকে বলেছি, অস্ত্রগুলো কোত্থেকে এসেছে, কোথায় যাবে, এগুলোর বাহক কারা, এটা যদি চোরাচালানের জন্য আনতে হয়, তাহলে দেশীয় আইনে প্রমাণ করতে হলে দেখতে হবে যে, আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য হয়েছে।

এখানে বিচারিক আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, অস্ত্রগুলো পাশের কোনো দেশে পাচারের জন্য আনা হয়েছে। আমরা হাইকোর্টকে এটাই বলার চেষ্টা করেছি। আদালতের কাছে ন্যায়বিচার পেয়েছি।

তিনি বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার মতো এ মামলায়ও প্রথম একটি তদন্তের পর ২৮ সাক্ষীর সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছিল। এর পর সরকার বদলের ফলে আবার তদন্ত ও বিচার পরিবর্তন হয়ে একটি রায় হয়। এ মামলার বিচারিক আদালতে সব আসামিকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। এটা আমার ওকালতি জীবনে কমই দেখেছি।

প্রেক্ষাপট

২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে আটক করা হয় ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান। এ নিয়ে কর্ণফুলী থানায় অস্ত্র আইন ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে চোরাচালানের অভিযোগ এনে দুটি মামলা করা হয়। পরে তদন্তে দেখা যায়, চীনের তৈরি এসব অস্ত্র ও গোলাবারুদ সমুদ্রপথে আনা হয় ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র জন্য। বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ওই চালান ভারতে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। 

২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র আটক-সংক্রান্ত দুটি মামলার মধ্যে চোরাচালান মামলায় (বিশেষ ক্ষমতা আইনে) সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া এবং দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান। আর অস্ত্র আইনে করা অন্য মামলাটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পান একই আসামিরা। এ ছাড়া অস্ত্র আটক মামলার অন্য ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড দেন বিচারক। দণ্ড পাওয়া প্রত্যেক আসামিকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। অস্ত্র আইনে করা আরেক মামলায় বিচারিক আদালত সব আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সেই মামলা হাইকোর্টে আপিলের শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। 

চট্টগ্রাম জজ আদালতের রায়ের পর ২০১৪ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রায়সহ মামলার নথিপত্র হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়, যা ডেথ রেফারেন্স মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়। অন্যদিকে কারাগারে থাকা দণ্ডিত আসামিরা সাজার রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে হাইকোর্টে আলাদা আপিল করেন। 

গত ৬ নভেম্বর চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানের ঘটনায় করা মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ১৩ কার্যদিবস শুনানি শেষে গতকাল রায় দিলেন হাইকোর্ট। 

নেত্রকোনায় আনন্দ মিছিল

নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর খালাস পাওয়ায় নেত্রকোনার খালিয়াজুরীতে গতকাল বুধবার সন্ধ্যায় আনন্দ মিছিল ও মিস্টি বিতরণ করেছে স্থানীয় বিএনপি। এ ছাড়া উপজেলার নগর ইউনিয়নের নয়াগাঁও বাজার, লেপসিয়া বাজার, বোয়ালী বাজার, কৃষ্ণপুর, জগন্নাথপুরেও নেতাকর্মীরা আনন্দ মিছিল বের করেন।

আরও পড়ুন

×