বুয়েট শিক্ষার্থীর মৃত্যু
প্রাইভেটকার চালকসহ দু’জনের শরীরে অ্যালকোহল ও গাঁজার উপস্থিতি

পূর্বাচলে পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে প্রাইভেটকারের ধাক্কায় নিহত বুয়েট শিক্ষার্থী মোহতাসিম মাসুদের লাশ বাসায় নেওয়া হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রাইসা সুলতানা। শুক্রবার বিকেলে গ্রিন রোড এলাকায়- সমকাল
সমকাল ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০১:২২ | আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:৪৮
ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার ৩০০ ফুট সড়কে ঘুরতে গিয়েছিলেন তিন বন্ধু মোহতাসিম মাসুদ, মেহেদী হাসান খান ও অমিত সাহা। তিনজনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী। রাতে ফেরার পথে বালু ব্রিজের যাত্রী ছাউনির সামনে পুলিশের তল্লাশি চৌকির (চেকপোস্ট) মুখে পড়েন তারা।
এ সময় একটি বেপরোয়া গতির প্রাইভেটকার চেকপোস্ট ভেঙে মোটরসাইকেলে থাকা তিনজনকে চাপা দেয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নিলে মোহতাসিমকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। মেহেদী রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে ও অমিত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
গত বৃহস্পতিবার রাতে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত মোহতাসিম বুয়েটের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল (সিএসই) বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। আহত মেহেদী ও অমিত তাঁর সহপাঠী। এর মধ্যে মেহেদী কুমিল্লা সদরের মফিজুর রহমান খানের ছেলে এবং অমিত ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তপন কুমার সাহার ছেলে। তারা বুয়েটের আহসানউল্লাহ হলে থাকেন। আর মোহতাসিম ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গার মাসুদ মিয়ার ছেলে। তিনি পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর গ্রিন রোডের বাসায় থাকতেন। ভোরে দুর্ঘটনায় মোহতাসিমের মৃত্যুর খবর পান মা-বাবা। একমাত্র ছেলের মৃত্যু তারা মানতে পারছেন না।
গতকাল সড়ক পরিবহন আইনে রূপগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন মোহতাসিমের বাবা। ঘটনায় জড়িত তিনজনকে ঘটনাস্থল থেকে আটকের পর ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন– প্রাইভেটকারের চালক মুবিন আল মামুন (২০)। তিনি মিরপুর ডিওএইচএস এলাকার বাসিন্দা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুল্লাহ আল মামুনের ছেলে। অন্য দু’জন হলেন প্রাইভেটকারে থাকা মিরপুরের পীরেরবাগ এলাকার রিজওয়ানুল করিমের ছেলে মিরাজুল করিম (২২) এবং উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের বাহাউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে আসিফ চৌধুরী। গ্রেপ্তার তিনজনই শিক্ষার্থী ও পরস্পর বন্ধু।
শরীরে অ্যালকোহলের উপস্থিতি
পুলিশ জানিয়েছে, এদিন প্রাইভেটকারের চালকের আসনে ছিলেন মুবিন। দুর্ঘটনার পর পুলিশ তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স পায়নি। গাড়িটির নিবন্ধন মুবিনের বাবা সাবেক সেনা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুনের নামে। প্রাইভেটকারে মদের একটি খালি বোতল ও এক ক্যান বিয়ার পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তার তিনজন মদ্যপ ছিলেন কিনা– নিশ্চিত হতে দুপুরে নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (ভিক্টোরিয়া) ডোপ টেস্ট করা হয়।
জেলা সিভিল সার্জন আ ফ ম মুশিউর রহমান জানান, প্রাইভেটকারের চালক মুবিনের শরীরে অ্যালকোহলের উপস্থিতি মিলেছে। আরোহীদের মধ্যে মিরাজুলের শরীরে অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। অন্যজন আসিফের শরীরে অ্যালকোহল জাতীয় কিছু পাওয়া যায়নি।
নারায়ণগঞ্জের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী ইসলাম জানান, পরীক্ষায় মুবিন ও মিরাজুলের ফল ‘পজিটিভ’ এসেছে। মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকার জব্দ করেছে পুলিশ।
দুর্ঘটনার বর্ণনায় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রূপগঞ্জ থানার এসআই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পূর্বাচল ৩০০ ফুট সড়কে বেড়ানোর পর রাত ৩টার দিকে নীলা মার্কেট এলাকায় যাচ্ছিলেন তিন শিক্ষার্থী। মোটরসাইকেল চালাচ্ছিলেন মোহতাসিম। বালু ব্রিজের ওপর চেকপোস্টে মোটরসাইকেল থামিয়ে ‘নীলা মার্কেট কোন দিকে’– পুলিশ সদস্যদের কাছে জানতে চান তারা। এর পরপরই একটি দ্রুতগতির প্রাইভেটকার চেকপোস্টের ব্যারিকেড ভেঙে ঢুকে মোটরসাইকেলে থাকা তিনজনকে ধাক্কা দেয়। এতে গুরুতর আহত হন তারা। পরে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়া হলে তাদের অ্যাম্বুলেন্সে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার করা হয়
প্রাইভেটকারের চালকসহ তিনজনকে। গতকাল তাদের নারায়ণগঞ্জ আদালতে তুলে পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। তবে এদিন রিমান্ড শুনানি হয়নি। আগামীকাল রোববার রিমান্ড শুনানির দিন ধার্য করে তাদের কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।
বিকেলে নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত চত্বরে যান গ্রেপ্তার মুবিন আল মামুনের বাবা সেনাবাহিনীর সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি একটি গাড়িতে বসা ছিলেন। তাঁর দাবি, তাঁর ছেলে মুবিনের ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল।
কান্না থামছে না মা-বাবার
নিহত মোহতাসিমের স্বজন জানান, তাঁর বাবা মাসুদ মিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রশাসনিক কর্মকর্তা। এক ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে মোহতাসিম বড়। স্ত্রী রাইসা সুলতানা ও দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি গ্রিন রোডে বসবাস করেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মোহতাসিম মোটরসাইকেল নিয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হন। রাত ১১টায় তাঁকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন মা। তখন মোহতাসিম জানিয়েছিলেন, তিনি বন্ধুদের সঙ্গে আছেন। এর পর ভোরে ছেলের মৃত্যুর খবর পান মা-বাবা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে বিকেলে গ্রিন রোডের বাসায় মরদেহ নেওয়া হয়। এ সময় ছেলেকে শেষবারের মতো দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাইসা সুলতানা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শেষবিদায় দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাবা, তুমি শান্তিতে ঘুমাও। আবার দেখা হবে।’
মাসুদ মিয়া বলেন, ‘পুলিশের তল্লাশি চৌকিতে মোহতাসিমের মোটরসাইকেল থামিয়ে কাগজপত্র চাওয়া হয়। মোটরসাইকেল থেকে নেমে সে কাগজপত্র বের করছিল। তখনই মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালিয়ে এসে তাকে চাপা দেওয়া হয়।’
বুয়েট শিক্ষার্থীদের সংবাদ সম্মেলন
ঘটনার খবর পেয়ে গতকাল ভোরে রূপগঞ্জ থানায় যান বুয়েটের শতাধিক শিক্ষার্থী। থানার বাইরে তারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পরে দুপুরে রাজধানীর পলাশীর মোড়ে সংবাদ সম্মেলন করে ছয় দফা দাবি ঘোষণা করেন শিক্ষার্থীরা। দাবির মধ্যে রয়েছে– যে কোনো মূল্যে এই হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতকরণ; আহতদের চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যয়ভার অবশ্যই বিবাদীপক্ষকে বহন করতে হবে; নিহত মাসুদের পরিবারকে যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতে বিবাদীপক্ষকে বাধ্য করতে হবে; তদন্তকাজে বাধা দেওয়ার চেষ্টা হলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে হবে; আহতদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর বিষয়ে বুয়েট কর্তৃপক্ষকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে; সড়ক দুর্ঘটনার কারণে যাতে আর কারও প্রাণ না ঝরে, সে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে বুয়েট শিক্ষার্থী মো. তূর্য বলেন, অতীতেও আমরা দেখেছি, অপরাধী প্রভাবশালী হলে বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটিয়ে, ভুক্তভোগীর পরিবারকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা না করার জন্য চাপ দেয়। প্রাথমিকভাবে মামলা হলেও পরে বিভিন্ন ধাপে তা তুলে নেওয়ার জন্য প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ প্রভাব খাটায়, কিংবা আরও নানাভাবে ছাড় পেয়ে যায়। এটা আমরা হতে দিতে পারি না। আমরা আমাদের ভাইয়ের হত্যার সুষ্ঠু ও অতিসত্বর বিচার চাই।
এদিকে মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোয় আগেও দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন অনেক পথচারী। এর মধ্যে ২০২১ সালের নভেম্বরে মহাখালীতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি প্রাইভেটকার উড়াল সেতুর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে উল্টে দুমড়েমুচড়ে যায়। এতে ওই গাড়িতে থাকা ওমর আইয়ান ও ফাহমিদ আহমেদ রায়হান নামে দুই ছাত্র নিহত হন। আহত হন গাড়িচালক মহসিনসহ পাঁচজন। আহতদের মধ্যে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের ছোট ছেলে ইশরাক আহমেদ স্বাধীন ছিলেন। সে সময় পুলিশ জানিয়েছিল, তারা রাতে একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বেসামাল অবস্থায় ছিলেন। এর পর গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন।
২০১৮ সালের ১৯ জুন রাতে নোয়াখালীর সাবেক এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে সাবাব চৌধুরী মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর সময় মহাখালীতে সেলিম ব্যাপারী নামে একজনকে চাপা দেন। ঘটনাস্থলেই ওই পথচারীর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া ২০২৩ সালের এপ্রিলে মালিবাগ এলাকায় মদ্যপ অবস্থায় বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে রিকশা ও মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেন এক যুবক। একই বছরের ১১ আগস্ট রাতে তেজগাঁও এলাকায় বেপরোয়া গতির প্রাইভেটকারের চাপায় একজন নিহত ও দু’জন আহত হন।
২০২২ সালের ২০ জানুয়ারি মধ্যরাতে ধানমন্ডিতে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালিয়ে একটি রিকশায় ধাক্কা দেন মডেল-অভিনেত্রী অর্চিতা স্পর্শিয়া ও তাঁর বন্ধু প্রাঙ্গণ দত্ত অর্ঘ্য। এ সময় তারা পুলিশের হাতে ধরা পড়েন।
- বিষয় :
- বুয়েট
- বুয়েট শিক্ষার্থী
- প্রাইভেটকার