জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো তৈরিতে ঐকমত্য জরুরি

খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপ। ছবি: সংগৃহীত
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০২:০০ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৭:৫৯
স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে কোনো জাতীয় নীতি, পরিকল্পনা বা কাঠামো হয়নি। সরকারে যারা এসেছে, তারা মর্জিমাফিক করেছে। তবে এখন জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে কাঠামো তৈরি জরুরি হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে।
শনিবার রাজধানীর খামারবাড়ি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজের ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপের শেষ দিনে এ অভিমত দেন বক্তারা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক শাফকাত মুনিরের সঞ্চালনায় সংলাপের শেষ অধিবেশনে ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা ইস্যুতে বক্তৃতা করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির, গণসংহতির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওবায়দুল হক, এবি পার্টির যুগ্ম সচিব দিদারুল আলম, সমন্বয়ক আরিফ সোহেল ও তাহসিন রিয়াজ।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘দ্বিমত থাকবে। একই বিষয়ে বিভিন্ন সমাধানও থাকে। তবে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্য থাকা দরকার। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই আছে। যেসব দেশে দুটি বড় দল আছে, সেখানেও আলোচনার ভিত্তিতে অনেক কিছু নির্ধারিত হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গত ৫৩ বছরে এমন হয়নি। সব সময় ক্ষমতাসীনরা যেটি ভালো মনে করেছে, তা-ই করেছে।’
তিনি বলেন, ‘অনেক সময় সরকারি দল সঠিক সিদ্ধান্ত নিলেও বিরোধী দল বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করে। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দেশের স্বার্থে বৃহৎ ঐক্য প্রয়োজন। সেখানে আলোচনা হবে। একতরফা কিছুই হবে না।’
সংলাপে অংশ নেওয়া এক দর্শকের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সেনাপ্রধানের বৈঠক সম্পর্কে আমরা অবগত। এতে গোপনীয় কিছু ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘বলা হয়, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ। কিন্তু বাস্তবে উল্টো দেখছি। এখানে রাষ্ট্রের চেয়ে একটা গ্রুপ বা অলিগার্কদের স্বার্থ বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক দলের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকা গুরুত্বপূর্ণ।’
তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘাত আছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে সখ্য আছে। আমাদের এ তিনটি দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে, ভারত ও চীনের মধ্যে এত শত্রুতা। কিন্তু সেখানে বাণিজ্যের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। আমাদের প্রতিটি দেশের সঙ্গে স্বার্থ আছে। আমরা যেহেতু আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী নই, তাই আমাদের এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রেখে চলতে হবে।’
সম্প্রতি থাইল্যান্ডে মিয়ানমার ইস্যুতে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সীমান্ত, অপরাধ ও মাদক এবং মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনা হয়। সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যু ছিল না। তবে বাংলাদেশ বৈঠকে বলেছে, ইস্যুগুলোর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান ছাড়া একটি ইস্যুরও মীমাংসা হবে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘সাইড লাইন বৈঠকে আমি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে বলেছি। রোহিঙ্গাদের দুই লাখ তরুণ-তরুণী আছে। তারা আগ্রাসী হলে বাংলাদেশসহ প্রতিটি দেশেরই ক্ষতি হবে। মিয়ানমারে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হবে। তা না হলে মিয়ানমারের প্রতিবেশী কেউই শান্তিতে থাকতে পারবে না।’
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূল ও পার্বত্যাঞ্চলে আরাকান আর্মির প্রভাব বাড়তে পারে– এমন আশঙ্কায় সেনাবাহিনীকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে অনুরোধ জানান বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে কথা বললেই শুধু শান্তি বাহিনীর কথা বলছি। কিন্তু ওদিকে আরও বড় বিপদ, সীমান্তের ওপারের এলাকা আরাকান আর্মির দখলে। তারা বাঙালি ও ইসলামবিদ্বেষী; রোহিঙ্গাদের জন্যও আশীর্বাদস্বরূপ নয়। তারা নতুন করে ৫০-৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে ঠেলে দিয়েছে। আরাকান আর্মির পাশাপাশি ভারতও সীমান্ত এলাকায় জটিলতা তৈরি করেছে।’
আমীর খসরু বলেন, ‘সীমান্তে এখন যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ সীমান্ত এলাকা নিয়ে নীতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে।’ বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রতিটি গোয়েন্দা সংস্থাকে এখন পুনর্গঠনের পাশাপাশি নতুন করে তাদের করণীয় নির্ধারণ করে দিতেও পরামর্শ দেন তিনি।
আমীর খসরু আরও বলেন, ‘আমাদের এখন একটি জাতীয় নিরাপত্তা কাঠামো বা ন্যাশনাল সিকিউরিটি আর্কিটেকচার গড়ে তুলতে হবে। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে ঐকমত্য গড়ে তুলতে হবে। নিরাপত্তা কাঠামো বলতে শুধু সীমান্ত পাহারা নয়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যোগাযোগ ব্যবস্থা, খাদ্য নিরাপত্তা– সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’
সংস্কার বিষয়ে বিএনপির এ নেতা বলেন, ‘যে কোনো সংস্কারই এ দেশে হয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়। এখন রাজনীতির বাইরে কেউ এসে বলবেন, তারা সবকিছু ঠিক করবেন। রাজনীতিবিদদের বাদ দিয়ে সেটি হবে না। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে আসুন, তার পর যা চাইছেন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে করুন।’
জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গত সাড়ে ১৫ বছরের পররাষ্ট্রনীতি ছিল গদি রক্ষার নীতি। এখানে কোনো পররাষ্ট্রনীতি, দেশের স্বার্থ ছিল না। এতে দেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তা নানাভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল। কানেকটিভিটি, যৌথ প্রকল্প বা উদ্যোগের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামে আমাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে। বিগত সরকার গদি রক্ষার স্বার্থে অপরাপর শক্তিকে খুশি করেছে। এর মধ্যে ভারত প্রধান জায়গায় ছিল। মিয়ানমারের সঙ্গেও বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষা করে– এমন কোনো পররাষ্ট্রনীতি ছিল না।’
ওবায়দুল হক বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে আলোচনায় আমাদের একটা ক্লান্তি চলে এসেছে। এ নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থাকে বাঙালি-পাহাড়ি বিরোধ বা শান্তি চুক্তির মতো বিষয়গুলো নিয়ে। এখানে আরও অনেক ভূরাজনৈতিক দিক রয়েছে, যা নিয়ে বড় করে আলোচনা হয় না। কানেকটিভিটির নিরাপত্তার বিষয় আলোচিত হয়নি। তবে আঞ্চলিক কানেকটিভিটির ফলে অর্থনৈতিক যে ফায়দা রয়েছে, তা ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে।’ কানেকটিভিটি হওয়ার পর এ থেকে অর্থনৈতিক উপযোগিতা কতটুকু এসেছে– এমন প্রশ্ন ছুড়ে দেন তিনি।
- বিষয় :
- জাতীয় ঐক্য
- সংলাপ
- নির্বাচন