মেয়াদোত্তীর্ণ ও মানহীন সিলিন্ডারে বাড়ছে দুর্ঘটনা

ফাইল ছবি
হাসনাইন ইমতিয়াজ
প্রকাশ: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:৩০ | আপডেট: ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৩
প্রাকৃতিক গ্যাসের সীমাবদ্ধতায় দেশজুড়ে রান্নার কাজে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি)। ‘সিলিন্ডার গ্যাস’ নামে বহুল ব্যবহৃত এই জ্বালানি যেমন সহজলভ্য, তেমনি বিপজ্জনক। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতাহতের খবর আসছে। ফিলিং স্টেশনে পরিবহনে গ্যাস ভরার সময়ও দুর্ঘটনা ঘটছে। গ্যাস সিলিন্ডার যেন মৃত্যুদূতে পরিণত হয়েছে। শহরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গ্যাসের পুরোনো জীর্ণ পাইপলাইনগুলোও হয়ে উঠেছে মৃত্যুফাঁদ। এ ছাড়া পুরোনো পাইপলাইনের লিকেজ গ্যাস থেকে আগুন ধরছে। এতে দগ্ধ হচ্ছে মানুষ।
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যমতে, গত পাঁচ বছর গ্যাসলাইন ও সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ এবং আগুন লাগার ঘটনায় ৪৪ জন মারা গেছেন। আহত হয়েছেন শতাধিক। এসব দুর্ঘটনায় প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
সর্বশেষ গত শুক্রবার সাভারের আশুলিয়ায় একটি আবাসিক ভবনে গ্যাস বিস্ফোরণে শিশুসহ অন্তত ১১ জন দগ্ধ হন। ৯ ফেব্রুয়ারি মাদারীপুরে গ্যাস সিলিন্ডারের পাইপ ফেটে (লিকেজ) বিস্ফোরণে দগ্ধ হন একই পরিবারের তিনজন। এর আগে ১১ ডিসেম্বর লক্ষ্মীপুর-রামগতি রুটে চলাচলকারী আল-মদিনা পরিবহন গ্রিনলিফ ফিলিং
স্টেশনে গ্যাস নেওয়ার সময় হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়। ২০২১ সালের ২৭ জুন মগবাজারের একটি ভবনে তিতাসের পাইপের লিকেজ থেকে বের হওয়া গ্যাসের বিস্ফোরণে ১২ জন প্রাণ হারান।
যেভাবে ঘটে দুর্ঘটনা
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিকৌশল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াছির আরাফাত খান সমকালকে বলেন, সাধারণত এলপিজি গ্যাস ২ শতাংশ ও লাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস ৫ শতাংশ বাতাসের সংস্পর্শে এলেই তা বিস্ফোরণের ঝুঁকি তৈরি করে। লাইন গ্যাসের চেয়ে ১০-১২ গুণ চাপ কম থাকে সিলিন্ডার গ্যাসে। ফলে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হলে ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। তবুও দেশে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, গৃহস্থালির বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটছে গ্যাস লিকেজ থেকে। মূলত সিলিন্ডার থেকে কানেক্টিং পাইপ, চুলার রাবার কিংবা রেগুলেটরের ত্রুটি থেকে গ্যাস লিকেজ হচ্ছে। তা হয়তো বদ্ধ ঘরে জমা হচ্ছে। এক পর্যায়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা কোনোভাবে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটছে।
পাইপলাইনের দুর্ঘটনার বিষয়ে খাত-সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুরোনো লাইনের পাশাপাশি চলছে অবৈধ সংযোগ, আছে নিম্নমানের পাইপের ব্যবহার। রক্ষণাবেক্ষণেরও ঠিক নেই। অপরিকল্পিত রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি চলে বছরজুড়ে। এসব কারণে গ্যাসের পুরো বিতরণ নেটওয়ার্ক বিপৎসংকুল হয়ে উঠেছে।
যে কারণে দুর্ঘটনা
পরিবেশদূষণ কমাতে যানবাহনে গ্যাসের ব্যবহার শুরু হয় ২০০০ সালের দিকে। দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ তেলচালিত যানবাহন সিএনজিচালিত করা হয়েছে। রান্নার কাজে এলপিজি সিলিন্ডারের ব্যবহার শুরু হয় ২০০৫ সালে। বর্তমানে সাড়ে ৪ কোটির বেশি এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে। বাসাবাড়ি ছাড়াও পরিবহনে ও ক্ষুদ্র শিল্পের জ্বালানি হিসেবে এলপিজি বা এলপি গ্যাস ব্যবহার করছেন অনেকেই। এ দুই খাতের বাইরে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন গ্যাসের সিলিন্ডার রয়েছে। এর সংখ্যা অর্ধ লাখের মতো।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার, অব্যবস্থাপনা ও অবৈধ ব্যবহারের ফলে বিপদ বাড়ছে। স্থানীয় পর্যায়ে অনেক ব্যবসায়ী অনুমোদন ছাড়া নিজেরাই সিলিন্ডার ভরে গ্যাস বিক্রি করছেন। এটাকে বলা হচ্ছে, ‘ক্রস ফিলিং’। এটি অনিরাপদ। কারণ, এলপিজি কোম্পানিগুলোতে আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সিলিন্ডারে গ্যাস ভরা হয়। সিলিন্ডার পরীক্ষা করে বাল্ব ও সেফটি ক্যাপ বসানো হয়। আর ক্রস ফিলিংয়ে বাল্ব বসানো হয় হাতের সাহায্যে। তাই সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে।
ব্যবহারে অসতর্কতার কারণে সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, পরিবহনের সময় সিলিন্ডার কাত করে রাখলে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ে। ট্রাকে তোলার সময় অনেক সময় শ্রমিকরা সেটি ছুড়ে দেন। এতে সিলিন্ডারের নিরাপত্তা বেষ্টনী দুর্বল হয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।
এলপিজি সিলিন্ডারের দুর্ঘটনার বড় কারণ মানহীন রেগুলেটর ও পাইপের ব্যবহার। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, এলপিজি সিলিন্ডারজনিত ১০ ঘটনার মধ্যে ৭টিই রেগুলেটর-সংক্রান্ত।
পরিদপ্তরের সাবেক এক পরিদর্শক বলেন, সাধারণত সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয় না। বিস্ফোরণ ঘটে সিলিন্ডারের অন্য যন্ত্রাংশে। রেগুলেটরসহ অন্যান্য যেসব যন্ত্রাংশ বাজারে পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই নিম্নমানের। এ ছাড়া সিলিন্ডার রাখা হয় চুলার একদম কাছে। ব্যবহারের পর ঠিকমতো বন্ধও করা হয় না। ফলে গ্যাস লিকেজ হয়ে দুর্ঘটনা ঘটে।
এদিকে দেশজুড়ে এলপিজি ব্যবসার সম্প্রসারণ ঘটলেও তা তদারকিতে পর্যাপ্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) সিলিন্ডার পরীক্ষণে মাত্র একটি পরীক্ষাগার রয়েছে, তাও চট্টগ্রামে। বেসরকারি কোম্পানিগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সিলিন্ডার পরীক্ষা করে।
একটি বেসরকারি এলপিজি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, বাজারে তাদের ৫০ লাখ সিলিন্ডার আছে। প্রতিটির মেয়াদ ২৫ থেকে ৩০ বছর। এই মেয়াদকালে তিনবার সিলিন্ডারের নিরাপত্তা পরীক্ষা হয়– প্রথমে ১০ বছর, দ্বিতীবার ১৫ বছর, সর্বশেষ পাঁচ বছর পর। এ ছাড়া প্রতিবার গ্যাস ভরানোর সময় তারা ‘হাইড্রো টেস্ট’ করেন। সমস্যা দেখলে সেই সিলিন্ডার বাতিল ঘোষণা করা হয়।
যানবাহনে দুর্ঘটনার জন্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডার দায়ী। জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, ব্যাপক চাহিদার কারণে অননুমোদিত সিএনজি রূপান্তর প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেখানে অদক্ষ কারিগর দিয়ে সিএনজিচালিত গাড়ির রূপান্তর কার্যক্রম চলে, যা ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তিনি আরও বলেন, নিয়মিত পরীক্ষা না করার কারণেও সিলিন্ডার ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ব্যবহারের কারণে সিলিন্ডারের ভেতরে অনেক ক্ষয় হয়ে থাকে। এই ক্ষয় থেকেও ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা। এ জন্য নিয়মিত সিলিন্ডারের পরীক্ষা করা উচিত।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে দেড় থেকে দুই লাখ মানহীন সিলিন্ডারযুক্ত গাড়ি চলছে। গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে সিলিন্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও বিস্ফোরণ ঘটে। ২০১৯ সালের ১৯ আগস্ট কুমিল্লার রিভারভিউ সিএনজি স্টেশনে একটি বাসের দুর্ঘটনার তদন্তে জানা যায়, সিলিন্ডারের মাঝের অংশের পুরুত্ব কম থাকায় গ্যাস ভরার সময় চাপ সহ্য করতে না পেরে বিস্ফোরণ হয়। এতে একজন প্রাণ হারান।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিএনজি ফিলিং স্টেশন অ্যান্ড কনভার্সন ওয়ার্কশপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর বলেন, দুর্ঘটনা ঘটে সিলিন্ডারের মানহীন সংযোগ থেকে। অনেক ক্ষেত্রে নকল সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়, যার বিস্ফোরণ ঘটে সহজেই।
এদিকে রাস্তাঘাটে, মেলায় গ্যাস বেলুন বিক্রেতারা যে সিলিন্ডার ব্যবহার করেন, তা খুবই বিপজ্জনক। মানহীন সিলিন্ডারে হাইড্রোজেন ভরতে গিয়ে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। এ-সংক্রান্ত সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর। এক বেলুন বিক্রেতা এলপিজি সিলিন্ডার থেকে বেলুনে গ্যাস ভরার সময় বিস্ফোরণে সাত শিশু নিহত হয়।
তিতাসের লাইন পুরোনো
ঢাকা বিভাগে গ্যাস সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত তিতাস গ্যাসের ১২ হাজার ২৫৩ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় আছে ৭ হাজার কিলোমিটার। এর ৬০ শতাংশ অতি ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে ২০ থেকে ৪০ বছরের পুরোনো বিতরণ পাইপলাইনও আছে। মাঝেমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু লাইন পাল্টানো হলেও ধারাবাহিক রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম তেমন নেই।
বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সাবেক প্রধান পরিদর্শক শামসুল আলম বলেন, ঝুঁকি কমাতে নিম্নমানের সিলিন্ডার আমদানি বন্ধ ও অবৈধ কনভার্সন সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করা প্রয়োজন। সিলিন্ডারের নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে কোনো সংস্থার মাধ্যমে একটা মান নির্ধারণ করতে হবে। সেই মান মানছে কিনা, তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। সিলিন্ডার ব্যবসার লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। সিলিন্ডারের সঙ্গে ব্যবহারের নিয়মকানুন ও প্রয়োজনীয় সতর্কতাসংবলিত লিফলেট বিতরণ করতে হবে।
বিস্ফোরক অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে তাদের জনবল সংখ্যা ১০৮। এই সীমিত লোকবল দিয়ে সারাদেশে মাঠ পর্যায়ে সিলিন্ডার নিরীক্ষা করা সম্ভব নয়। বিতরণ কোম্পানির লিকেজ শনাক্ত ও পুরোনো পাইলাইন প্রতিস্থাপনে সরকারকে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে।
- বিষয় :
- সিলিন্ডার বিস্ফোরণ