প্রজ্ঞাপন জারি
তিন সচিবসহ ২২ কর্মকর্তার বাধ্যতামূলক অবসর

সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ১৭:০৩ | আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ২৩:০৫
বিতর্কিত শেষ তিন সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ২২ কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আলাদা প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এসব নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন পর্যায়ক্রমে তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা সে সময়ের ৩৩ জেলা প্রশাসককে গত বুধবার বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করার পরদিনই এই সিদ্ধান্ত এলো। এর আগেও কয়েকজনকে ওএসডি করা হয়েছিল।
প্রজ্ঞাপন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাধ্যতামূলক অবসরে যাওয়া ২২ জনের মধ্যে চারজন ২০১৪ সালের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তাদের মধ্যে তিনজন সচিব, ১৭ জন অতিরিক্ত সচিব, একজন যুগ্ম সচিব ও একজন উপসচিবের দায়িত্বে ছিলেন। জনস্বার্থে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪ সালের দশম ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত ও সমমনারা বর্জন করেন। তবে ২০১৮ সালে তারা ভোটে এলেও আগের রাতেই সিল মেরে বাক্স ভর্তি করে নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করানোর অভিযোগ ওঠে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব মোখলেস উর রহমান গতকাল সাংবাদিকদের জানান, এসব নির্বাচনে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের মধ্যে যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের কম তাদের ওএসডি করা হচ্ছে। যাদের চাকরির বয়স ২৫ বছরের বেশি, তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হচ্ছে।
জনপ্রশাসন সচিব বলেন, জনগণের হয়ে সরকার অনেক শক্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করছে। যারা অবসরে গেছেন তাদের বিরুদ্ধেও দুদক মামলা করছে। অবসরে যাওয়া মানেই মুক্তি নয়। জনস্বার্থে সরকার এখানে ছাড় দেবে না। যাদের নামে দুর্নীতি, আইনের বাইরে গিয়ে অতিরঞ্জিত কিছু করার অভিযোগ আছে, চাকরিবিধিতে যার যেটা প্রাপ্য, সেই শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে যুক্ত থাকাদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০২৪ সালের নির্বাচনে যারা যুক্ত ছিলেন, তাদের তালিকা গোয়েন্দা সংস্থার কাছ দেওয়া হয়েছে।
দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের তিন নির্বাচনের নানা অভিযোগের বিষয়ে জানতে গত ৯ ডিসেম্বর ৩০ রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাকে ডেকেছিল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। তখন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেছিলেন, “কর্মকর্তারা তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন। ওনারা বলেছেন, তেমন কিছু করার ছিল না। ‘কলকাঠি’ অন্য জায়গা থেকে নাড়ানো হয়েছে। এক অর্থে বলতে গেলে ওনারা অসহায় ছিলেন। তবে যারা নিচের কর্মকর্তা, তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মূল কথা বলেছেন আমাদের দেশ একটি ‘পুলিশি রাষ্ট্র’ হয়ে গিয়েছিল।”
বাধ্যতামূলক অবসরে তিন সচিব
জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার কারণে শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. কামরুল হাসানকেও বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছে সরকার। অন্যদিকে, ওএসডি থাকা সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। কামরুল হাসান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মৌলভীবাজারের ডিসি ও চট্টগ্রাম বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন। ‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮’ এর ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে তাদের বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বিধি অনুযায়ী অবসর সুবিধা পাবেন।
সাময়িক বরখাস্ত যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় দাস
এদিকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া এবং বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারণার অভিযোগে যুগ্ম সচিব ধনঞ্জয় দাসকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের আমলের আরেক বিতর্কিত কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানাকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় আরেকটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। চাকরির বয়স ২৫ বছর পূর্ণ হওয়ায় তাঁকে অবসরে পাঠানো হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে বলা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সায়লা ফারজানাকে ওএসডি করে সরকার। তিনি প্রশাসন ক্যাডার সার্ভিসের নারী কর্মকর্তাদের সংগঠন বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব ছিলেন। আওয়ামী লীগের সময় প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলাম তাঁর স্বামী। মনিরুল ইসলামকেও বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার।
একসঙ্গে বাধ্যতামূলক অবসরে দম্পতি
মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোখলেসুর রহমান সরকার ও ভূমি সংস্কার বোর্ডের সদস্য উম্মে সালমা তানজিয়া দম্পতিকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। মোখলেসুর রহমান সরকার গোপালগঞ্জের এবং সালমা তানজিয়া ফরিদপুরের ডিসি ও ময়মনসিংহের বিভাগীয় কমিশনার ছিলেন।
এ ছাড়া বাধ্যতামূলক অবসরে গেছেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবীর, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের মোহাম্মদ শফিউল আরিফ, বিদ্যুৎ বিভাগের ফয়েজ আহাম্মদ, বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস ও কপিরাইট নিবন্ধনের মো. তোফায়েল ইসলাম, কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের (আইসিটিডি) কামরুন নাহার সিদ্দীকা, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রাব্বী মিয়া, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম আলম, ইউএই আবুধাবি বাংলাদেশ দূতাবাসের মিনিস্টার লেবার মো. আব্দুল আওয়াল, বাংলাদেশ জাতীয় বিজ্ঞান ও কারিগরি তথ্য সংগ্রহ ও বিতরণ কেন্দ্রের (ব্যান্সডক) মহাপরিচালক মো. শওকত আলী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তন্ময় দাস, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের এনামুল হাবীব, পরিকল্পনা বিভাগের আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের মো. হামিদুল হক এবং জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘরের পরিচালক (যুগ্ম সচিব) ওয়াহিদুল ইসলাম।
জামালপুরের সেই ডিসি অবসরে
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ওএসডি থাকা উপসচিব আহমেদ কবিরকেও বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়েছে। আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশের ঘটনায় জামালপুরের সাবেক ডিসি আহমেদ কবীরকে ওএসডি করা হয়েছিল। শাস্তি হিসেবে তিনি কখনও আর পদোন্নতি পাবেন না বলেও প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।