ওকাপের গবেষণা প্রতিবেদন
জলবায়ুর প্রভাবে সিলেট ও পিরোজপুরে জীবন–জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন
ফেলোশিপ পেলেন চার সাংবাদিক

ছবি-সংগৃহীত
সমকাল প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮ মার্চ ২০২৫ | ২১:৪৭ | আপডেট: ১৮ মার্চ ২০২৫ | ২৩:৫৬
জলবায়ু পরিবর্তন এখন বিশ্বজুড়ে একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দেশের দীর্ঘ উপকূলরেখা ও নিম্নভূমি এলাকা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে সিলেট ও পিরোজপুর জেলায় জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মানুষের জীবন ও জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সিলেটে ৯৫ ভাগ উত্তরদাতা তাপমাত্রা বৃদ্ধির কথা জানিয়েছেন, যা কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ৫৬ ভাগ কৃষক ফসলহানির শিকার হয়েছেন। যার ফলে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে। অভিবাসনের হারও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে অভিবাসন নিরাপদ ও টেকসই না হওয়ায় অনেকেই শ্রম শোষণ, মানব পাচার ও আধুনিক দাসত্বের শিকার হচ্ছেন। অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর এক হোটেলে ‘রাউন্ডটেবিল কনসাল্টেশন ও মিডিয়া ফেলোশিপ ২০২৫’ শীর্ষক পরামর্শক সভায় এ গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ কে এম সোহেল।
আরও উপস্থিত ছিলেন ফ্রেন্ডশিপের সিনিয়র ডিরেক্টর কাজী এমদাদুল হক, এফইএস-এর রেসিডেন্ট রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. ফেলিক্স গারডেস, সিডার ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার মোস্তাফিজুর রহমান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ফেলোশিপ জুরি বোর্ডের সদস্য মো. আবদুল মালেক, ডেইলি স্টারের সাংবাদিক পরিমল পালমা, ওকাপের চেয়ারপারসন শাকিরুল ইসলাম ও নির্বাহী পরিচালক ওমর ফারুক চৌধুরী প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে এ বছর চারটি ক্যাটাগরিতে চার সাংবাদিককে ফেলোশিপ প্রদান করা হয়েছে। তারা হলেন- প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মো. মহিউদ্দিন নিলয়, ডিবিসি নিউজের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক তাহসিনা সাদেক, ডেইলি স্টারের স্টাফ রিপোর্টার আবদুল্লাহ মো. আব্বাস ও জাগোনিউজে‘র স্টাফ রিপোর্টার রায়হান আহমেদ।
ওকাপের গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৮১ ভাগ দুর্যোগকবলিত মানুষ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ঋণ নিয়েছেন, যার মধ্যে ৫৮ ভাগ বারবার ঋণের চক্রে পড়েছেন। এক ঋণ শোধ করতে গিয়ে তারা নতুন ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছেন এবং চরম অর্থনৈতিক সংকটে পড়ছেন। এই পরিবারগুলোর অনেকেই ঋণ শোধ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে অভিবাসনের পথ বেছে নিচ্ছেন।
এতে আরও বলা হয়, পিরোজপুরে ৭২ ভাগ কৃষক মাটির লবণাক্ততার কারণে ফসলের উৎপাদন হ্রাসের কথা জানিয়েছেন, এবং ৬৬ ভাগ জেলে মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার কথা বলেছেন। নদী ভাঙ্গনের ফলে ৪৭ ভাগ পরিবার কৃষিজমি হারিয়েছে, যা তাদের খাদ্য সংকট ও কর্মসংস্থানের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সিলেট ও পিরোজপুরের ৪১.৯৮ ভাগ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য অভ্যন্তরীণ অভিবাসী, এবং ২৮.০৯ ভাগ পরিবারের অন্তত একজন সদস্য আন্তর্জাতিক অভিবাসী। অভ্যন্তরীণ অভিবাসীদের মধ্যে ৯২ ভাগ শ্রম শোষণের শিকার হয়েছেন, যেখানে ৫৬ ভাগ বিলম্বিত বা আংশিক মজুরি পেয়েছেন, ৪৩ ভাগ বিনা পারিশ্রমিকে অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের ৯৯ ভাগ কোনো না কোনোভাবে আধুনিক দাসত্বের শিকার হয়েছেন। তারমধ্যে, ৮১ ভাগ অভিবাসীর মজুরি আটকে রাখা হয়েছে, ৬৭ ভাগ এর পাসপোর্ট জব্দ করা হয়েছে, এবং ৪৫ ভাগ হুমকি ও ভয়ভীতির শিকার হয়েছেন। বিশেষত গৃহকর্মী নারীরা শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৬ ভাগ অভিবাসী ছয়টিরও বেশি রকমের শ্রম শোষণের শিকার হচ্ছেন, যা চরম মাত্রার নির্যাতনের ইঙ্গিত দেয়।
ওকাপের চেয়ারপার্সন শাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দুর্যোগের মাত্রা ও ক্ষতির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ১৯৬০-১৯৯০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে বছরে গড়ে ৪টি বড় দুর্যোগ ঘটত, যা ১৯৯০-২০২২ সালের মধ্যে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। একই সময়ে, প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত বাৎসরিক গড় ক্ষতির পরিমাণ ১৪৫.৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৫৫৭.৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।’
তিনি আরও বলেন, সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী সহায়তার অভাবের কারণে দুর্যোগপ্রবণ এলাকার মানুষ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ব্যর্থ হচ্ছেন। বর্তমানে দুর্যোগকালীন সহায়তা হিসেবে খাদ্য, ত্রাণ, কাজের বিনিময়ে খাদ্য সহায়তা বা এককালীন ঘর মেরামতের অর্থ সহায়তা প্রদান করা হলেও এটি মোটেও পর্যাপ্ত নয়। ফলে, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ টিকে থাকার জন্য ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হচ্ছেন।
সভায় জলবায়ু-প্রবণ অঞ্চলের মানুষের জন্য টেকসই সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, নিরাপদ কর্মসংস্থান ও শ্রম অধিকার নিশ্চিত করা এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসীদের মজুরি ও শ্রম অধিকার রক্ষায় গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত চুক্তি করার সুপারিশ করা হয়েছে।
- বিষয় :
- গবেষণা প্রতিবেদন