অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার
‘ঈদডা এহন পাথরের মতো ভারী বোঝা’

শহীদ আকাশ বেপারির স্ত্রী-সন্তান
ইয়াসির আরাফাত
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫ | ০০:৩৪
‘আগের ঈদেও দুই মেয়ের জন্য দুই সেট করে জামা কিনে দিল যে মানুষটা, সে আর নাই।
এহন আমাগো ঈদ নাই। ঈদডা এহন পাথরের মতো ভারী একটা বোঝা।’ এভাবেই নিজের কষ্টের কথা বলছিলেন জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে শহীদ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক আকাশ বেপারির স্ত্রী লাকী আক্তার। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয় তাঁর স্বামীর। সেই থেকে দুঃসহ স্মৃতির বোঝা বয়ে বেড়ানো শুরু। সেই সঙ্গে তিন সন্তানকে নিয়ে
খেয়েপরে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই এখন তাঁর নিত্যদিনের সঙ্গী।
অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতরা সরকারি-বেসরকারি সহায়তা পেলেও আকাশ বেপারির জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকা-সংক্রান্ত জটিলতায় পরিবারটি জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে কোনো অর্থ পায়নি। গত বৃহস্পতিবার উত্তরার বাউনিয়া বটতলা এলাকার বাসায় কথা হয় লাকী আক্তারের সঙ্গে। ঈদের কেনাকাটা কিছু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলছিলেন, ‘সেমাই-চিনি কিনতে পারিনি এখনও। আমার বড় ছেলেটা প্রতিবন্ধী, আর দুই মেয়ে আছে। বাসা ভাড়া, ভরণপোষণ করে এই সংসার চালানো কঠিন, ঈদের কেনাকাটা করার অবস্থা আমার নাই।’
আকাশ বেপারির বড় মেয়ে কণা আক্তার (১৫) বলছিল, ‘ঈদের আগে আব্বু গভীর রাত করে বাসায় ফিরতেন, বেশি টাইম ভাড়া মারতেন। গত ঈদেও আমরা সবাই উত্তরার রাজলক্ষ্মীতে গিয়ে জামা কিনেছিলাম। আমরা জামাকাপড় কিনলেও বাবা কিছু কিনতে চাইতেন না। গত ঈদে বলছিলাম, তুমি না নিলে আমি কিছু কিনব না। তখন বললেন, আমার পাঞ্জাবিটা তো এখনও নতুনই আছে। অথচ ওই পাঞ্জাবিটা আরও দুই ঈদ আগে কেনা।’
ধানমন্ডির সায়েন্সল্যাব এলাকায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের সামনে গত বছরের ১৯ জুলাই হেলিকপ্টার থেকে আসা গুলিতে শহীদ হন ১৯ বছর বয়সী আল আমিন শুভ। শুভর মা রেণু বেগমের সঙ্গে কথা হয় বৃহস্পতিবার ইফতারের আগে। তিনি বলেন, ‘শুভ রিকশা চালায়ে ২৫ রোজার আগেই ভাই-বোনদের জামা কিনা দিত। গত ঈদে ওদের সঙ্গে সঙ্গে আমাকেও কাপড় কিনা দিছে। এতদিন অনেক অর্থকষ্টে ভুগেছি। তবে কয়দিন আগে আমি চার লাখ এবং শুভর বাবা ১ লাখ টাকা জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাইছে। বড় ছেলে সোহানকে একটা অটোরিকশা কিনে দেব ভাবছি।’
রাজধানীর পান্থপথে গত বছর ১৯ জুলাই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালালে প্রাণ হারায় ১৩ বছরের শিশু মোবারক হোসাইন। কাঁঠালবাগানের বক্স কালভার্ট রোডে মোবারকের বাবা রমজান আলী ও মা ফরিদা বেগমের সঙ্গে কথা হয়। ঈদ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে রমজান আলী বলেন, ‘আমরা তো বড়, আমাদের তো পোশাক-আশাক কেনার তেমন তাড়া থাকে না। কিন্তু মোবারককে ঈদের কয়েকদিন আগেই কিনে দিতাম যতটুকু পারতাম।’
অশ্রুসজল চোখে রমজান আলী বলেন, ‘ঈদের দিন মোবারক গরুর মাংস খেতে পছন্দ করত। নতুন জামাকাপড় পরে বন্ধুদের নিয়ে ঘোরাঘুরি করত। সন্তানের আনন্দ দেখতেই ভালো লাগে। এইবার আমার কলিজার টুকরা আজিমপুর কবরস্থানে ঘুমায়। আমাদের জীবনে আর কীসের ঈদ।’
আন্দোলনকালে হতাহতের তথ্য সংগ্রহ, তালিকা প্রস্তুত ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে কাজ করছে ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’। সংগঠনটির আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান সমকালকে বলেন, ‘শহীদ পরিবার ও আহতদের প্রাপ্য সম্মানটুকু বুঝিয়ে দিতে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনকে আরও তৎপর হতে হবে। এমনও পরিবার আছে, যারা নিরুপায় হয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরছে। ফাউন্ডেশন ও সরকার যা করছে, এর গতি আরও বাড়ানো সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু পরিবারের ক্ষেত্রে এমন আছে– কাগজপত্র ঠিকমতো নেই, তাদের ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। অনেক পরিবারে হয়তো শহীদের বাবা-মায়ের সঙ্গে শহীদের স্ত্রীর বোঝাপড়া ভালো নেই। স্ত্রী-সন্তান অর্থ পাচ্ছে, সেটা তাদের প্রাপ্য। কিন্তু অসহায় বাবা-মা থাকলে তাদের জন্যও একটা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।’
- বিষয় :
- অভ্যুত্থান