প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর
গোল বেধেছে গবেষণায়

ফাইল ছবি
সাব্বির নেওয়াজ
প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫ | ০১:১৬ | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৫ | ০৭:৫০
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) করা আটটি গবেষণার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ছয় মাসের গবেষণাকাজ শেষ করা হয়েছে দুই মাসে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির টাকায় করা হলেও গবেষণার বিষয়বস্তুতে স্থান পেয়েছে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার বিষয়। এর জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে গবেষণার তথ্য-উপাত্ত নিয়েও।
অভিযোগ পেয়ে শুরুতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের যাচাই কমিটি বিষয়টি তদন্ত করে। কমিটির প্রতিবেদনে গবেষণায় নানা অস্বচ্ছতার কথা বলা হয়। প্রায় ছয় কোটি টাকার এ গবেষণার জন্য আইইআরকে ইতোমধ্যে ৮৭ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। তদন্তের পর বাকি ৫ কোটি ১৩ লাখ টাকা আটকে দিয়েছে অধিদপ্তর।
এখন ঘটনার বিশদ তদন্ত করতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এ কে মোহাম্মদ সামছুল আহসানকে প্রধান করে ছয় সদস্যের পৃথক উচ্চতর কমিটি গঠন করা হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো. মাসুদ রানা সমকালকে বলেন, ‘বিষয়টি নজরে আসার পর আমি পিপিআর (পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস) অনুসারে ব্যবস্থা নিতে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছি।’
সূত্র জানায়, গবেষণা প্রতিবেদন জমা হওয়ার পর এর প্রশাসনিক প্রক্রিয়া ও মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মিরাজুল ইসলাম উকিল এ কমিটির সভাপতি। অন্য সদস্যরা হলেন অধিদপ্তরের অপর পরিচালক (পলিসি ও অপারেশন) মোহাম্মদ কামরুল হাসান, উপপরিচালক (অর্থ) এইচ এম আবুল বাশার, উপপরিচালক (প্রশিক্ষণ) মো. আব্দুল আলীম এবং শিক্ষা অফিসার (আইএমডি) মো. শরীফ উল ইসলাম। কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই গবেষণা করানোর জন্য যথাযথ প্রশাসনিক অনুমোদন ছিল না। অস্বাভাবিক দ্রুত সময়ে গবেষণার কাজ শেষ করা হয়েছে।
এ প্রতিবেদন পাওয়ার পর শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) এ কে মোহাম্মদ সামছুল আহসানকে প্রধান করে ছয় সদস্যের উচ্চতর কমিটি গঠন করে দেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক। এই কমিটি গবেষণার মানের বিষয়টি পর্যালোচনা করবে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র বলছে, আওয়ামী লীগের পতনের আগে গবেষণার কাজ দেওয়া হয়।
নথিপত্রে দেখা যায়, চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৪) আওতায় বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের মাধ্যমে আটটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। গত ৯ এপ্রিল প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে এ-সংক্রান্ত সভা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে সম্পাদিত আটটি গবেষণার কাঠামো, প্রক্রিয়া ও বিধিগত যথার্থতা যাচাই করে আইইআরকে বিল দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে মতামত দিতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সদস্যরা আটটি গবেষণা প্রতিবেদনের নানা বিষয় পর্যালোচনা করেন। তারা সংশ্লিষ্টদের লিখিত বক্তব্য গ্রহণ ও কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট বিভাগ) হামিদুল হক বলেন, প্রকিউরমেন্ট বিভাগ গবেষকদের সঙ্গে চুক্তি করেছে। এখন তারা যদি গবেষণা না করেন বা ছয় মাসের গবেষণা দুই মাসে করেন, সেটি তাদের বিষয়। আর বিল দেওয়ার দায়িত্ব অর্থ বিভাগের। তাই গবেষণার বিষয়, সময় ও যৌক্তিকতা নিয়ে কিছু বলার নেই।
নথিপত্রে দেখা যায়, ২০২৪ সালে অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পিইডিপি-৪) উত্তম কুমার দাশের সভাপতিত্বে একটি সভা হয়। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের মাধ্যমে আটটি গবেষণা সম্পাদনের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। এ কাজের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। আইইআরকে সিঙ্গেল সোর্স পদ্ধতিতে কাজ দেওয়া হয়।
গবেষণাগুলো হলো– স্টাডি অন ডেভেলপমেন্ট লিডারশিপ ট্রেনিং ফর হেড টিচার্স অব প্রি-প্রাইমারি এডুকেশন, স্টাডি অন ডিমান্ড অ্যাসেসমেন্ট ফর দ্য প্রি-ইবতেদায়ি এডুকেশন ইন মাদ্রাসা, স্টাডি অন দ্য ডেভেলপমেন্ট অব ট্রিচার্স ট্রেনিং কারিকুলাম অ্যান্ড সফট স্কিলস, স্টাডি অন নিডস অ্যাসেসমেন্ট অব লাইফ স্কিল ট্রেনিং ইন দ্য প্রাইমারি এডুকেশন, স্টাডি অন দ্য ডেভেলপমেন্ট এ লিডারশিপ ট্রেনিং ম্যানুয়াল ফর দ্য ইনস্টিটিউশনাল হেড অব মাদ্রাসা, ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর দ্য প্রি-সার্ভিস টিচার এডুকেশন ফর প্রাইমারি টিচার, স্টাডি অন দ্য সিচুয়েশন অ্যানালাইজ অব প্রাইমারি টিচার্স ট্রেইনিং ইনস্টিটিউট এবং স্টাডি অন ইভালুয়েটিং দ্য অনগোয়িং রিমোট টিভিইট প্রোগ্রাম বাই ডিইটি।
কমিটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাঁচটি বিষয়ে আটটি শিরোনামে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে। কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, গবেষণার বিষয়বস্তু পর্যালোচনায় দেখা যায়, প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ও বর্তমান সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে গবেষণা করা হয়েছে। গবেষণার বিষয় নির্ধারণের যৌক্তিকতা নিরূপণের দাপ্তরিক কোনো প্রমাণও পাওয়া যায়নি। দাখিল করা অন্তত দুটি গবেষণা মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও একটি কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর পরিচালিত গবেষণাগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের কোনো অনুরোধপত্র পায়নি কমিটি। সর্বোপরি ৫ কোটি ৭৮ লাখ ২৯ হাজার টাকায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনার লক্ষ্যে আইইআরের সঙ্গে সমঝোতা স্বাক্ষরের আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নেওয়ারও কোনো কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কোনো সভা/কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়নি। এতে পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নবিদ্ধ।
পিপিআর অনুযায়ী ব্যয় নির্ধারণ কমিটি তিন সদস্যের হওয়ার বিধান থাকলেও শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৯ সদস্যের দরমূল্য নির্ধারণ কমিটি করা হয়। বেশি সদস্য হওয়ায় দরমূল্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার সম্ভাবনাকে ক্ষীণ করেছে বলে মত দিয়েছে কমিটি।
আটটি গবেষণার জন্য প্রতিষ্ঠান নিয়োগে গঠিত কমিটি ও অনুমোদিত প্রাক্কলন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুটি গবেষণার বিষয়বস্তু এবং প্রকৃতি একই রকম হওয়া সত্ত্বেও দরমূল্য নির্ধারণ কমিটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ মূল্য অনুমোদন করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গবেষণাগুলোর জন্য মাত্রাতিরিক্ত বাজেট ধরা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরিতে আসার আগের প্রাক-চাকরি শিক্ষা প্রশিক্ষণ সম্ভাব্যতা নিয়ে গবেষণার জন্য প্রতি মাসে তিন লাখ টাকা করে তিন মাসে ৯ লাখ, লিড কনসালট্যান্ট ছয়জনের জন্য প্রতি মাসে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে তিন মাসের জন্য ৪৫ লাখ টাকা, গবেষণা সহযোগীদের প্রতিজন প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকাসহ মোট বাজেট ১ কোটি ২৭ লাখ ২৭ হাজার টাকা ধার্য করা হয়েছে। কমিটি একে অস্বাভাবিক বলেছে।
গবেষণার কাঠামোগত দুর্বলতা তুলে ধরে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিটি গবেষণায় ব্যবহৃত নমুনা যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয়নি। গবেষণাগুলো খুব তাড়াহুড়া করে সম্পন্ন করা হয়েছে। ফলে পর্যালোচনা, টুলস উন্নয়ন, টুলস ভেলিডেশন, টুলস অবহিতকরণ, ডেটা কালেকশন, ডেটা ম্যানেজমেন্ট, ডেটা অ্যান্ট্রি, ডেটা অ্যানালাইসিস ইত্যাদি পর্যায়ে পর্যাপ্ত সময় নেওয়া হয়নি বলে কমিটির কাছে মনে হয়েছে। গবেষণাগুলো পরিচালনায় আদর্শ গবেষণা কাঠামোও অনুসরণ করা হয়নি।
তদন্তে দেখা যায়, কমিটিকে একাধিক সভার কার্যবিবরণী সরবরাহ করা হলেও সভার নোটিশ ও হাজিরার তথ্য পাওয়া যায়নি, যা সভাগুলো অনুষ্ঠিত না হওয়ার প্রমাণ। এ অবস্থায় আইইআরকে অবশিষ্ট অর্থ প্রদান করা ঠিক হবে না বলে কমিটি মত দেয়।
কমিটি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মপরিধিভুক্ত গবেষণাগুলোর বিল পরিশোধের ক্ষেত্রে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের মতামত নেওয়ার সুপারিশ করেছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআরের পরিচালক অধ্যাপক হোসনে আরা বেগমের বক্তব্য জানতে গত ২৭ ও ২৮ মে দু’দিন এ প্রতিবেদক তাঁর দপ্তরে যান। দু’দিনই প্রতিবেদককে কয়েক ঘণ্টা করে বসিয়ে রাখা হয়। পরে কথা বলা সম্ভব নয় বলে জানানো হয়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান সমকালকে বলেন, এ গবেষণার নানা প্রশাসনিক ও প্রক্রিয়াগত ত্রুটি ধরা পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির টাকায় গবেষণা হলেও এতে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষার বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। তার জন্য মাদ্রাসা ও কারিগরি অধিদপ্তরগুলোর কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। শামসুজ্জামান বলেন, ‘চার কিস্তিতে আইইআরকে পুরো টাকা দেওয়ার কথা ছিল। তারা একটা সেমিনার করেছিল। এরপর আমরা এক কিস্তির টাকা ছাড় করেছিলাম। গবেষণা মানসম্মত না হলে আমরা চুক্তি বাতিলও করতে পারি।’
দুদকের অভিযান, তদন্ত
বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ২ জুন দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ও উপসহকারী পরিচালক এলমান আহাম্মদ অনির নেতৃত্বে এনফোর্সমেন্ট টিম প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মিরপুর কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, গবেষণার জন্য কোনো প্রস্তাব কিংবা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন না থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষার তিনটি গবেষণায় খরচ করা হয়। দুদক বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছে।
- বিষয় :
- শিক্ষা