চেক জালিয়াতির মামলা সাড়ে ৫ লাখ
ভোগান্তির শেষ নেই বিচারপ্রার্থীদের

ওয়াকিল আহমেদ হিরন
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:০৮ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:৪২
ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা ব্যবসায়ী মারুফ হোসেন ১২ লাখ টাকার একটি চেক জালিয়াতির মামলা করেন ২০১৫ সালে। তার কোম্পানির ম্যানেজার থাকা অবস্থায় সোহেল নামে এক ব্যক্তি ১৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেন। সালিশের মাধ্যমে ১২ লাখ টাকা ফেরত দিতে চান সোহেল। ওই বছর ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি মারুফকে ১২ লাখ টাকার একটি চেকও দেন। চেকটি মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জমা দিলে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় তা ডিজঅনার হয়। এ বিষয়ে সোহেলকে উকিল নোটিশ দিলেও টাকা পরিশোধ না করে তিনি যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। ফলে ওই বছর ২১ জুলাই সোহেলের বিরুদ্ধে চেক জালিয়াতির মামলা করেন মারুফ। গত ৪ বছরেও মামলাটি সুরাহা হয়নি। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মামলার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে।
আইনজীবী আবদুস সামাদ একজন মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি করার জন্য সাভারে একটি ব্যাংকের শাখা থেকে ৪০ লাখ টাকা গৃহঋণ নেন ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ১২০ কিস্তিতে পরিশোধের জন্য ব্যাংক তাকে দশ বছরমেয়াদি এই ঋণ মঞ্জুর করে। ২০১৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত তিনি পরিশোধ করেন ৩৪ লাখ টাকা। জমা টাকার রসিদ সংশ্নিষ্ট আদালতে রয়েছে। এ ছাড়া ঋণ নেওয়ার সময় বাড়ির মর্টগেজ দলিল, শতাধিক পাতার ব্লাঙ্ক চেক, বাড়ির পাওয়ার অব অ্যাটর্নি ওই ব্যাংকের হেফাজতে রাখা হয়। এ পর্যায়ে ব্যাংকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ইচ্ছামতো টাকার পরিমাণ বসিয়ে আবদুস সামাদের বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের মিথ্যা মামলা করেছেন আদালতে। এভাবে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কতিপয় অসাধু ব্যক্তি গ্রাহককে মিথ্যা হয়রানি করছে। হয়রানির শিকার হচ্ছেন অগণিত মানুষ।
সাংসারিক অনটনে পড়ে সমবায় সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন রাজধানীর পল্লবীর গৃহবধূ রহিমা বেগম। জামানত হিসেবে তার কাছ থেকে রাখা হয়েছিল একটি ব্লাঙ্ক চেক। প্রতি মাসে তিনি সমিতির কিস্তি পরিশোধ করেছেন। ২ বছরে পরিশোধ করেছেন ২০ হাজার টাকার বেশি। তারপরও একদিন তার বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে বাসায় হাজির পুলিশ। আড়াই লাখ টাকা দাবি করে মামলা ঠুকে দেওয়া হয়েছে। টাকা নেওয়ার সময় কথা ছিল কিস্তি পরিশোধ হলে চেক ফেরত পাবেন। যদিও কোনো লিখিত চুক্তি ছিল না। কিন্তু সমিতির নামে স্থানীয় সুদ কারবারিরা প্রতারণা করে তার সঙ্গে। ঋণের ৩ গুণ টাকা শোধ করলেও ফেরত পাননি চেক। পরে গ্রেফতার এড়াতে বাবার বাড়ি থেকে সম্পত্তি বিক্রি করে সুদ কারবারিদের অন্যায্য দাবি মেটাতে বাধ্য হন।
এভাবে চেক জালিয়াতির মামলা বেড়েই চলেছে। নেগোশিয়েবল ইন্সট্রুমেন্ট অ্যাক্টে (এনআই) দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা এখন সাড়ে ৫ লাখের উপরে। এনআই অ্যাক্টের মামলা থেকে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য ফৌজদারি মামলা। তৈরি হচ্ছে আর্থসামাজিক অস্থিরতা, টানাপড়েন, পারিবারিক অশান্তি। চেকের মামলায় আত্মহত্যা, হার্ট অ্যাটাক, ব্রেইনস্ট্রোক করে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। পাশাপাশি আত্মগোপন কখনও বা বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। আইনজ্ঞরা বলছেন, চেক ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাবও একটি বড় সমস্যা। দৈনন্দিন জীবনে চেকের ব্যবহার বাড়ছে প্রতিনিয়ত। পাশাপাশি প্রতারণার ঘটনায় উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। সারাদেশের আদালতে সাড়ে ৩৫ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন থাকলেও শুধু নিম্ন আদালতে রয়েছে সাড়ে পাঁ?চ লাখের বেশি চেক জালিয়াতির (এনআই অ্যাক্ট) মামলা। এসব মামলায় বিচারের মুখ দেখেছেন খুব কম বাদীই। প্রতারিত হচ্ছেন সহজ-সরল মানুষও। বছরের পর বছর বিচারের জন্য আদালতে ঘুরছেন তারা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় বিচারপ্রার্থীর চেকের টাকা মামলায় দ্বিগুণ খরচ হয়ে যাচ্ছে।
প্রতিদিন অগণিত বিচারপ্রার্থী আদালতে বছরের পর বছর ঘুরছেন। তারা জানিয়েছেন, চেক প্রতারণার মামলায় আদালতে এসে এমনভাবে ঘুরতে হলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থা আর থাকে না। তাদের মতে, একটি মামলা শুনানির জন্য বছরে একটি তারিখ ধার্য করা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি।
জানা গেছে, চেক ডিজঅনারের মামলার অধিকাংশ বিবাদী প্রভাবশালী ও বিত্তবান। এ মামলাটি জামিনযোগ্য হওয়ায় আইনের ফাঁকফোকর ও উচ্চ আদালতের নির্দেশে জাল চেক প্রদানকারীরা বেরিয়ে যাচ্ছেন। ফলে ঝুলে যাচ্ছে অসংখ্য মামলা, উচ্চ আদালতের নির্দেশে অধিকাংশ মামলার বিচার কার্যক্রমও স্থগিত থাকছে দীর্ঘদিন। আইনজীবীরা বলছেন, চেক ডিজঅনারের মামলার জন্য নির্দিষ্ট আইন থাকলেও তা দুর্বল। বিচারপ্রার্থীর কোনো কাজে আসে না। তারা বলেন, আদালত থেকে দীর্ঘ সময় নিয়ে তারিখ দেওয়ায় বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকছে মামলা। সময় ক্ষেপণের পাশাপাশি বাড়ছে বিচারপ্রার্থীদের ভোগান্তি।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আগস্ট মাস পর্যন্ত ঢাকা মহানগরের ৩৩টি আদালতে প্রায় ১ লাখ ২৩ হাজার চেক জালিয়াতির মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ঢাকার ১৬টি মহানগর দায়রা জজ আদালত ও ১০টি বিশেষ জজ আদালসহ বিভিন্ন আদালতে চেক জালিয়াতির (এনআই অ্যাক্ট) মামলা হয়ে থাকে। জানা গেছে, ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে শতাধিক ব্যক্তি চেক জালিয়াতির ফাঁদে পড়ে আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছেন। এভাবে প্রতি বছর ৫০-৬০ হাজার মানুষ মামলার জালে আটকা পড়ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।
জানা গেছে, গত বছর এসব আদালতে ৩৮ হাজার মামলা করেন প্রতারিতরা। ঢাকার সিএমএম আদালতে চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত এ আদালতে ২২ হাজারের মতো নতুন মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ৮ হাজার মামলাই চেক জালিয়াতির।
সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাকা উদ্ধারের জন্য এনআই অ্যাক্টে মামলা করা হয়। এসব মামলার অনুসন্ধান বা কোনো তদন্ত হয় না। তার চেয়ে অনেক বেশি টাকা আইনজীবী ও আদালত-সংশ্নিষ্টদের পেছনে খরচ হয়ে যায়। দীর্ঘ দিনেও এসব মামলার রায় না হওয়ায় হতাশ মামলার বাদীরা।
ঢাকা মহানগর পিপি আবদুল্লাহ আবু সমকালকে বলেন, এ মামলা নিষ্পত্তি হয় ধীরগতিতে। চেক ডিজঅনার মামলার রায় হলেও বাদী তার টাকা ফেরত পান না। শাস্তি হয় কিন্তু আসামি কীভাবে টাকা পরিশোধ করবে সেটা রায়ে উল্লেখ থাকে না। অনেক আসামি পলাতক থাকায় তাকে খুঁজেও পাওয়া যায় না। এখানেই বাদীর আরেকবার ভোগান্তি। এটা কমাতে হবে। ওই আদালত থেকে আসামির মালপত্র ক্রোক করে টাকা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
অ্যাডভোকেট আবদুস সামাদ সমকালকে জানান, বর্তমান সময়ের ব্যবধানে আইনটির বেশকিছু প্রায়োগিক দুর্বলতা রয়েছে। এটাকে আরও যুগোপযোগী করা উচিত। উকিল নোটিশ ছাড়া এনআই অ্যাক্টের মামলা করা যাবে না, এমন বিধান সংযোজন করতে হবে।
আইনজীবী আশরাফ-উল আলম সমকালকে জানান, এনআই অ্যাক্টের মামলাগুলো জামিনযোগ্য ধারা হওয়ায় আসামিরা সহজে পার পেয়ে যায়। কিন্তু এ মামলার রায়ে তিন গুণ টাকা জরিমানা ও এক বছরের জেল দেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু যে ব্যক্তি মূল দেনা দিতে পারে না, সে কীভাবে তিনগুণ টাকা দেবে। এ ব্যাপারে আইন সংশোধন করে সহজ পথ বের করতে হবে।
সংশ্নিষ্টরা বলছেন, জরিমানার টাকা কীভাবে আদায় হবে, বাদী কীভাবে তার পাওনা টাকা পাবেন আইনে এর কোনো সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান বা ব্যাখ্যা নেই। এমন পরিস্থিতিতে চেক ডিজঅনার মামলার অনেক রায় অবাস্তবায়িত অবস্থায় রয়েছে বছরের পর বছর। এর কোনো সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না। বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তির অবসানের লক্ষ্যে এনআই অ্যাক্টের ১৩৮ ধারা সংশোধন করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।
এদিকে ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বরে এআই অ্যাক্টের বেশ কিছু সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠায় আইন কমিশন। নিরীহ, নিরপরাধ মানুষের হয়রানি রোধে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে সংশোধনীর সুপারিশটি পাঠানো হয়। দুই বছর হতে চললেও সেই সংশোধনী উদ্যোগের অগ্রগতি নেই।
আইন মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ১৮৮১ সালে প্রণীত হয় এনআই অ্যাক্ট। মূল এ আইনটি ১৯৯৪ সালের ২০০০ এবং সর্বশেষ ২০০৬ সালে সংশোধন হয়। তবে এই সংশোধনগুলো আইনের মৌলিক কাঠামোয় পরিবর্তন আনা হয়নি।
- বিষয় :
- চেক জালিয়াতি
- মামলা
- বিচারপ্রার্থী