ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

নতুন দিন নতুন স্বপ্ন

সবুজ শিল্পে 'সেঞ্চুরি'

সবুজ শিল্পে 'সেঞ্চুরি'

আদমজী ইপিজেডে অবস্থিত লিড সনদের প্লাটিনাম ক্যাটাগরির কারখানা রেমি হোল্ডিংসের অভ্যন্তরে সবুজের সমারোহ -সমকাল

আবু হেনা মুহিব

প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:১৪ | আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৫:৪২

পরিবেশসম্মত সবুজ কারখানার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন বা লিড সনদ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠান ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবি)। শিল্প কারখানার ভবন নির্মাণ থেকে শুরু করে পণ্য উৎপাদন পর্যন্ত ছোট-বড় সব স্তরে পরিবেশ সুরক্ষার বিষয়টি কতটা মানা হলো তা কঠিন তদারকি এবং চুলচেরা বিশ্নেষণ করে সর্বোচ্চ মানের কারখানাকে এ সনদ দেওয়া হয়। সম্মানজনক এ সনদ পাওয়া সবুজ কারখানার সংখ্যা এখন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। সবুজ পোশাক কারখানার সেঞ্চুরি করেছে বাংলাদেশ। মোট ১০১টি পোশাক কারখানা এই সনদ পেয়েছে। পাইপলাইনে আছে আরও পাঁচ শতাধিক। ইউরোপ, আমেরিকার তুলনায় সবুজ শিল্পের দৌড়ে বাংলাদেশ এগিয়েই থাকছে।

ইউএসজিবির খাতওয়ারি বিভিন্ন সূচকের রেটিং পয়েন্টে সবচেয়ে বেশি ৯৭ পয়েন্ট পেয়েছে আদমজী ইপিজেডে অবস্থিত রেমি হোল্ডিংস। ৮০-এর ওপরে রেটিং পাওয়া কারখানাকে প্লাটিনাম সনদ দেওয়া হয়। এই কারখানার সংখ্যাও বাংলাদেশেই বেশি। এ ধরনের কারখানার সংখ্যা এখন ২৫টি। বিশ্বের শীর্ষ ১০টি লিড কারখানার মধ্যে ৭টিই বাংলাদেশে। গোল্ড মানের কারখানার সংখ্যা ৬৫টি। সাধারণ লিড সনদ পেয়েছে বাকি দুটি কারখানা। এ নিয়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে সবুজ কারখানার সেঞ্চুরি হয়েছে। ২০১২ সালে ঢাকার অদূরে পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডের ভিনটেক্স ডেনিম স্টিডিও দিয়ে এই বিপ্লব শুরু হয়। দুঃখজনক ঘটনা হলো রানা প্লাজা ধসের পর দেশে-বিদেশে কট্টর সমালোচনার পর পরিবেশবান্ধব কারখানা নির্মাণে নতুন করে গতি আসে। এই বিপ্লবের সর্বশেষ সংযোজন ধামরাইয়ের কিউট ড্রেস।

বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক সমকালকে বলেন, সবুজ প্রযুক্তিতে সত্যি সত্যিই দেশের পোশাক খাত বদলে যাচ্ছে। নতুন বেশিরভাগ কারখানাই এ প্রক্রিয়ায় নির্মিত হচ্ছে। সংস্কারের সময় পুরনো কারখানাগুলোও একই পথে হাঁটছে। এতে প্রাথমিক ব্যয় বাড়লেও প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ছে। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে সবুজ উদ্যোগে অর্থায়ন থেকে ঋণদানের ব্যবস্থা থাকলেও ছোট উদ্যোক্তাদের পক্ষে এই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করা সম্ভব হচ্ছে না। তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা থাকলে দেশ লাভবান হবে।

কোনো উদ্যোক্তা লিড মানের কারখানা করতে চাইলে প্রথমে ইউএসজিবিতে নিবন্ধন নিতে হয়। ইউএসজিবি তারপর একটি নির্মাণ কোড দেয়। এই কোডেই স্থাপত্য, প্রকৌশলসহ সব নকশা থাকে। নির্মাণসামগ্রীর তালিকা, মান এবং কোন উৎস থেকে কোন সামগ্রী সংগ্রহ করতে হবে সে নির্দেশনারও উল্লেখ থাকে এতে। এরপর ইউএসজিবির নিবন্ধিত উপদেষ্টার নিবিড় তত্ত্বাবধানে নির্মাণ কাজ এগোতে থাকে। এরপরও সময়ে সময়ে তদারক করে ইউএসজিবি পরিদর্শক দল। অর্থাৎ  অনেক ব্যয় এবং কাঠখড় পুড়িয়েই অবশেষে মেলে লিড সনদ।

লিড সনদের জন্য অতি তুচ্ছ বিষয়কেও গুরুত্ব দিয়ে চুলচেরা বিশ্নেষণ করা হয়। যেমন, শুধু প্রকল্পের অবস্থান সূচকেই ২৬ রেটিং পয়েন্ট বিবেচনা করা হয়। এর মধ্যে স্থানীয়দের সহজ যাতায়াত, পরিবহন ব্যবস্থা, প্রাকৃতিক আলো-বাতাস ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার মতো পয়েন্ট রয়েছে। জ্বালানি ও পরিবেশ সূচকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারসহ ৩৫টি পয়েন্ট এবং পানির ব্যবস্থাপনা সূচকে ১০টি পয়েন্ট বিবেচনা করা হয়। এরকম ১১০ পয়েন্টের মধ্যে ৪০ থেকে ৪৯ পয়েন্ট পাওয়া কারখানাকে লিড সনদ দেওয়া হয়। ৫০ থেকে ৫৯ পয়েন্টের মধ্যে হলে লিডের সিলভার ক্যাটাগরি, ৬০ থেকে ৭৯ পয়েন্ট গোল্ড ও ৮০ পয়েন্টের ওপরের কারখানাকে প্লাটিনাম সনদ দেওয়া হয়।

লিড সনদ পেলে সুবিধা কি জানতে চাইলে উদ্যোক্তারা জানান, বিদেশি বড় বড় ব্র্যান্ড এবং ক্রেতার আস্থা বাড়ে। তাদের সঙ্গে দর কষাকষিতে এগিয়ে থাকা যায়। ব্র্যান্ডিং ইমেজ বাড়ে। দুর্ঘটনা সাধারণত হয় না। প্রাকৃতিক আলো-বাতাসেই চলে উৎপাদন। প্রাকৃতিক আলো-বাতাস বৈরী হয়ে উঠলে ব্যবহার করা হয় নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। ফলে কারখানার ভেতর সার্বক্ষণিক সহনীয় তাপমাত্রা থাকে। কাজের পরিবেশকে করে নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও স্বাস্থ্যসম্মত। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের সুবিধায় পানি, বিদ্যুৎ কম খরচ হয়। প্রাকৃতিক আলো এবং সোলার প্যানেলে উৎপাদিত বেশিরভাগ বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়। বর্জ্য নিঃসরণ কম হওয়ার ফলে শোধনে ব্যয় কম হয়। সর্বোপরি দীর্ঘমেয়াদে উৎপাদন ব্যয় কমে আসে। যদিও প্রাথমিকভাবে এরকম একটি কারখানা নির্মাণে সাধারণ কারখানার তুলনায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ ব্যয় বেশি হয়ে থাকে।

ইউএসজিবিসির ওয়েবসাইট থেকে জানা গেছে, লিড সনদের উদ্দেশ্য হচ্ছে পরিবেশ সুরক্ষা এবং সবুজ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সাশ্রয়ী উৎপাদন। এ কারণে সাধারণ প্রকল্প থেকে লিড সনদ পাওয়া প্রকল্পে জ্বালানি সাশ্রয় হয় ২৪ থেকে ৫০ শতাংশ। পানির ব্যবহার কমে আসে ৪০ শতাংশ, সলিড বর্জ্য উৎপাদন কম হয় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত। এ ছাড়া প্রকল্পের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় কম হয় ১৩ শতাংশ। একটি রেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে প্রকল্পের নকশা, নির্মাণ, পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ পর্যবেক্ষণের পর লিড সনদ দেওয়া হয়। লিড সনদ পাওয়া কারখানার উৎপাদিত পণ্যের গায়ে 'গ্রিন ট্যাগ' ব্যবহার করা হয়। এর অর্থ পোশাকটি পরিবেশসম্মত কারখানায় তৈরি হয়েছে। ফলে তুলনায় বাড়তি দর দিয়েও কেনেন সাধারণ ভোক্তারা।

দেশের প্রথম লিড সনদ পাওয়া কারখানা ভিনটেইজ ডেনিমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সাজ্জাদুর রহমান মিরধা সমকালকে জানালেন, বাংলাদেশের পোশাককে বিশ্বদরবারের একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখতে চান তারা। নিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং পরিবেশসম্মত উৎপাদনে ইকোসিস্টেমকে বিবেচনায় নিয়েছেন তারা। এতে শ্রমিক-ক্রেতার সুবিধা থেকে ভিনটেজ কারখানার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়া একটি পাখির কথাও ভাবতে হয়েছে। কোনো কমপ্লায়েন্স শর্ত নয়, পরিবেশের স্বার্থেই এ উদ্যোগ নিয়েছেন তারা।

ক্রমশ বৈরী হয়ে ওঠা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় পরিবেশসম্মত উৎপাদনের স্বার্থে সরকারের পক্ষ থেকেও সবুজ জ্বালানির শিল্প কারখানাকে প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। লিড সনদপ্রাপ্ত কারখানার ক্ষেত্রে করপোরেট কর ২ শতাংশ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের কারখানা নির্মাণে ঋণসহায়তার জন্য সবুজ অর্থায়ন নামে আলাদা ঋণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে পরিবেশসম্মত শিল্প উৎপাদন উৎসাহিত করতে কার্বন করারোপ, জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করাসহ বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনে পরিবেশ বিপর্যয়ে নাজুক অবস্থায় পড়া বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে জীবনহানি, শিল্প-বাণিজ্যের ক্ষতি, ফসলের ক্ষতি ও রাস্তাঘাটসহ অন্যান্য অবকাঠামোর ক্ষতি হচ্ছে। অবশ্য ঝুঁকি মোকাবেলায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক উদ্যোগের প্রশংসা করেছে আইএমএফ।

লিড সনদ পাওয়া ময়মনসিংহের ভালুকায় অবস্থিত এনভয় টেক্সটাইলের স্বত্বাধিকারী সাংসদ আবদুস সালাম মুর্শেদী সমকালকে বলেন, লিড সনদ পাওয়া বেশ কঠিন। অনেক কারখানা এ ধরনের প্রকল্প নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে ইউএসজিবিসি সনদ পাচ্ছে না। এ ছাড়া গ্রিন কারখানা গড়ে তোলার প্রাথমিক ব্যয়ও অনেক। এনভয় টেক্সটাইলে ব্যয় হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকা। তবে সবুজ প্রযুক্তিতে গড়ে তোলার পর এখন উৎপাদন ব্যয় কমেছে অনেক। একজন শ্রমিক একই সঙ্গে চারটি মেশিন চালাচ্ছেন। অপচয় হচ্ছে না। প্রাথমিক বিনিয়োগ একটু বেশি হলেও চূড়ান্ত বিচারে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যয়সাশ্রয়ী। ইউরোপ-আমেরিকার বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলো রফতানি আদেশ দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াও এনভয় টেক্সটাইল নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করছে। ফলে দেশের ব্র্যান্ড ইমেজ নিয়ে নতুন উপলব্ধি হবে বিশ্ববাসীর।

আরও পড়ুন

×