ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

চালে আমদানি শুল্ক হ্রাস

লাভ মিল মালিকের, ক্ষতি হবে কৃষকের

লাভ মিল মালিকের, ক্ষতি হবে কৃষকের

মিরাজ শামস

প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২০ | ২০:৩২

আমনের ভরা মৌসুমে চালের দাম বাড়ানোর মূল সুবিধাভোগী মিল মালিকরা। এখন কম শুল্কে আমদানি করা চালের মুনাফার একটি বড় অংশ তারাই পাবেন। এদিকে মৌসুমের শুরুতে এবার কৃষকরা ভালো দাম পেলেও বেসরকারি আমদানি শুরু হলে ধানের দাম কমে যেতে পারে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক। অন্যদিকে ভর মৌসুমের সময়ে চড়া দামে চাল কিনছেন ক্রেতারা। কম শুল্কে চাল আমদানি হলে বাজারে দাম কমার কোনো নিশ্চয়তা নেই বলে মনে করেন আড়তদার ব্যবসায়ীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আমনের ঘাটতি মেটাতে নির্দিষ্ট পরিমাণ চাল আগেভাগে সরকার আমদানি করলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। এতদিনে সরকারি গুদামে মজুদ বেড়ে যেত। চালের দাম নিয়ে কারসাজির সুযোগ পেতেন না মিল মালিকরা। মিলগুলো চড়া দামে চাল বিক্রি করেছে। অথচ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে চাল দেয়নি। এখন আবার তারাই আমদানির সুযোগ নিয়ে অতি মুনাফা করবে।

বর্তমানে বাজারে খুচরায় প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৮ থেকে ৫০ টাকায়, যা চলতি মাসের শুরুতে ৪২ থেকে ৪৪ টাকা ছিল। মাঝারি চাল ৪৬ থেকে ৪৮ টাকা ছিল। এখন তা বেড়ে ৫২ থেকে ৫৬ টাকায় উঠেছে। আর সরু চাল ৬২ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা ছিল ৫৫ থেকে ৫৭ টাকা। চালের দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক্ক সাড়ে ৬২ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশ নির্ধারণ করেছে। গত রোববার খাদ্যমন্ত্রী সরকারের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান।

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্য সচিব গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, এতদিন মিলগুলো অতিরিক্ত মূল্য নিয়েছে। সরকারের মজুদ কম থাকার এ সুযোগ নিয়েছে তারা। সরকার আগে চাল আমদানি করলে এ সুযোগ পেতেন না মিল মালিকরা। তবে বাজার নিয়ন্ত্রণে আমদানি শুল্ক্ক কমানোর সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে। নিয়ন্ত্রিতভাবে দ্রুত আমদানি করতে হবে। পাশাপাশি যারা বাজারে কারসাজি করেছেন, তাদের আমদানির সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না। পরিকল্পিতভাবে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু আমদানি করতে হবে। তা না হলে আবারও ঠকবেন কৃষকরা। অতিরিক্ত আমদানি হলে কৃষকরা ধানের দাম পাবেন না।

বিআইডিএসের সাবেক গবেষণা পরিচালক ড. এম আসাদুজ্জামান সমকালকে বলেন, মৌসুমের সময়ে এবার বেসরকারিভাবে চাল আমদানি করতে হচ্ছে। আগেভাগে সরকার তা আনলে এমন পরিস্থিতি হতো না। এখন সুযোগ নিয়ে মিল মালিকরা চালের আমদানি করবেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কৃষক। গতবার কৃষক দাম পাননি। এবার ভালো দাম পাচ্ছেন। এখন মিলগুলো চাল আমদানি করলে কৃষকরা দাম পাবেন না। এতদিন মিল মালিকরা বেশি দামে চাল বিক্রি করছেন। সরকারকে চাল দেননি। এখন তারাই আমদানি করবেন। ফলে দু'দিক থেকে চালকল মালিকরা লাভবান হবেন।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আমদানির সিদ্ধান্ত সরকারকে আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তাহলে ভর মৌসুমে চালের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির সুযোগ পেতেন না ব্যবসায়ীরা। তিনি বলেন, করোনা ও বন্যার কারণে সরকার বিতরণ বাড়িয়েছে। এতে মজুদ কমেছে। অন্যদিকে মিলগুলো সরকারকে খুব কম চাল সরবরাহ করেছে।

এতে সরকারের মজুদ ঘাটতি তৈরি হয়েছে। বাজারে যৌক্তিক মূল্য নিশ্চিত করতে মিলগুলোর ওপর তদারকি জোরদার করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

কারওয়ান বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী মইন উদ্দিন মানিক ও মো. ইউনুস মিয়া সমকালকে বলেন, কম শুল্ক্কে আমদানি হলেও চালের দাম কমবে, এমন নিশ্চয়তা নেই। শুল্ক্ক কমানোর ঘোষণার পরও মিলগুলোর দাম কমানোর কোনো লক্ষণ নেই। এখনও মিল থেকে আগের মতো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে। তার মতে, বিশ্ববাজারে চালের দাম বেশি। আমদানি করা চাল ২৫ শতাংশ শুল্ক্ক দিয়ে আনার পরে খুচরায় বর্তমান দামই থাকতে পারে। তখন দেশি চালের দাম আরও বাড়াবেন মিল মালিকরা। এতে শুল্ক্ক কমানোর সুবিধা মিলাররা নেবেন। অন্যদিকে আমদানি বেশি হলে কৃষকরা আবার ধানের দাম পাবেন না।

বর্তমানে সারাদেশে ৫৫৩টি বড় স্বয়ংক্রিয় চালকল রয়েছে। এর মধ্যে সাড়ে তিন শতাধিক মিল ভালোভাবে চালু আছে। এই চালকল মালিকদের মধ্যে অনেকেই আবার আমদানিকারক। বিশেষ করে কুষ্টিয়া, পাবনা, যশোর, বগুড়া, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট ও নওগাঁর মিলগুলো আমদানি করতে পারে। বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক কেএম লায়েক আলী সমকালকে বলেন, মিল মালিকদের মধ্যে আমদানিকারক আছেন। তবে আমদানির জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে অনুমতি নিতে হবে। কারা আমদানির অনুমতি পাবেন, তা এখন বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া আমদানির চাল আসতে সময় লাগবে। এতে আগামী মৌসুমে কৃষকের বোরোর দামে ক্ষতি হতে পারে।

অনিশ্চয়তার সংগ্রহ অভিযান: দেশে বছরে সাড়ে তিন কোটি টনের বেশি চাল উৎপাদন হয়। এর মধ্যে ১ কোটি ৪০ লাখ টন আসে আমন থেকে। আমন মৌসুমে খাদ্য মন্ত্রণালয় দুই লাখ টন ধান ও সাড়ে ছয় লাখ টন চাল কেনার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। গত ৭ নভেম্বর থেকে ধান-চাল সংগ্রহ শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬ হাজার ৩২৮ টন চাল ও ৩৫১ টন ধান কিনেছে খাদ্য অধিদপ্তর। মাত্র ১ লাখ ২৮ হাজার টন চাল সংগ্রহের জন্য মিলগুলো চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী চাল সংগ্রহ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় সরকারি গুদামে চালের মজুদ গত বছরের চেয়ে অর্ধেকে নেমে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টনে ঠেকেছে।

ওএমএসের আওতা বাড়ছে: খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ সমকালকে বলেন, চলতি বছরে করোনার কারণে চাল বিতরণ বেশি হয়েছে। এখন মৌসুমের সময়ে মজুদ বাড়াতে স্থানীয় পর্যায়ে সংগ্রহ চলছে। এবার ধানের দাম বেশি থাকায় স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ কম হলে আমদানির মাধ্যমে মজুদ বাড়ানো হবে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩ লাখ টন চাল আমদানি প্রক্রিয়াধীন। আন্তর্জাতিক দরপত্র দিয়ে এ চাল আমদানি করা হচ্ছে। তিনি বলেন, সাধারণ পরিবারের চালের চাহিদা মেটাতে ঢাকায় খোলা বাজারে বিক্রি (ওএমএস) চলছে। চালের দাম বৃদ্ধির কারণে চট্টগ্রামসহ আরও তিন জেলা শহরে ওএমএস দেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন হলে ওই তিন জেলায় ওএমএস চালু করা হবে।

আরও পড়ুন

×