ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের বই হাতেগোনা

ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধের বই হাতেগোনা

.

 লতিফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ০১:০২ | আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ | ১২:৪১

অনেক উল্লেখযোগ্য গবেষণাগ্রন্থ, ইতিহাস, স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই রয়েছে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। কিন্তু এখনও এ নিয়ে গবেষণার ব্যাপক অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষক ও পাঠকরা। অথচ প্রতিবছর অমর একুশে বইমেলায় বাংলাসহ দেশে প্রচলিত বিভিন্ন ভাষা, ভাষা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে ক’টি নতুন বই আসে, তার সংখ্যা হাতেগোনা। এবারের মেলায়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এবার মেলার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অংশ নিয়েছে ৬৩৫টি প্রতিষ্ঠান। তাদের স্টল ও প্যাভিলিয়নে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের অধিকাংশই সম্পাদনার; মৌলিক নয়। শিশু চত্বরের স্টলগুলোতেও ভাষা আন্দোলন ও একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে নতুন বই দেখা যায়নি। যদিও শিশু-কিশোরদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস এবং ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে পরিচিত করে তোলার মতো ভালো বইয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন অভিভাবকরা।

প্রাবন্ধিক ও গবেষক হাসনাত আবদুল হাই এ বিষয়ে বলেন, ‘একুশের চেতনা ছিল বাংলা ভাষাকে ভালোবাসা। বাংলাকে জীবনের সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়া। অথচ আমরা এখনও তা করে উঠতে পারিনি। সেটা বই ছাপিয়ে প্রকাশক আর পাঠকের মাধ্যমে করা যাবে না। এটা করতে হবে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা, যেমন বাংলা একাডেমিকে। বলা যায়, এত বছরে একুশের চেতনার আমরা আংশিক বাস্তবায়ন করেছি।’
ভাষা আন্দোলন নিয়ে এখন লেখালেখি কমে গেছে। কারণ, এখন লেখকরা নতুন বিষয় আর উপকরণ খুঁজে পাচ্ছেন না বলে দাবি করেন হাসনাত আবদুল হাই। তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন নিয়ে যদি লিখতে হয়, তবে এর ইতিহাস আর গবেষণা পড়ে নতুন দিক পাওয়া যাবে। মোটাদাগে যে বিষয়গুলো নিয়ে লেখার কথা, সেসব লেখা হয়েছে। তবে এর মধ্যে ছোট ছোট বিষয় রয়ে গেছে, সেসব নিয়ে লেখা যাবে। আবার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়েও নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে লিখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের সব ঘটনা সাধারণত একই। তবে এর মধ্যে অনেক বিস্তারিত লেখার বিষয় আছে। এখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে গবেষণা লেখালেখি হচ্ছে। তেমনি মুক্তিযুদ্ধে মোটাদাগের মধ্য থেকে অসংখ্য ছোটখাটো বিষয় আছে। এগুলো খোঁজার জন্য অধ্যবসায়, ধৈর্য দরকার।’

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং সাঁথিয়া উপজেলার গৌরীগ্রামে ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ড. এম আবদুল আলীম। তিনি জানান, ‘ভাষা আন্দোলন কোষ’, ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন : জেলাভিত্তিক ইতিহাস’, ‘ভাষাসংগ্রামীদের জীবনকোষ’, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের নানা প্রেক্ষাপটে বামপন্থি রাজনীতিবিদদের ভূমিকা নিয়ে বই প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি। বইমেলায় একুশের বই নিয়ে তিনি বলেন, ‘ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও গবেষণায় তরুণদের মধ্যে তেমন প্রবণতা আমি দেখি না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণার বইতেও তেমন অবস্থা। নতুন তথ্য সংগ্রহের প্রবণতা না থাকায় অনেকে খুব তাড়াহুড়ো করে বই প্রকাশ করেন। বইমেলায় তাই একুশের বই, মুক্তিযুদ্ধের বইয়ের সংখ্যা কম।’
অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাৎ হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন আর মুক্তিযুদ্ধের বই নিয়ে পাণ্ডুলিপির অভাব। গবেষকরা এ বিষয়ে নতুন বই বের করছেন না। যারা করছেন, তারা সম্পাদনা করছেন। এতে কপিরাইটের ভয়ে যার-তার লেখা প্রকাশে ঝুঁকি নিচ্ছি না।’

জানা গেছে, এবার মেলার ২০ দিনে বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বাতিঘর প্রকাশিত বদরুদ্দীন উমরের ‘আমাদের ভাষার লড়াই’। এ ছাড়া অন্যপ্রকাশ বের করেছে এম আবদুল আলীমের ‘ভাষা আন্দোলনে কংগ্রেস’ বইটি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে পাঁচটি বই। এর মধ্যে রয়েছে বদরুদ্দোজা হারুনের ‘ভাষাশহিদ আবুল বরকত: নেপথ্য-কথা’। ঐতিহ্য থেকে এসেছে প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরীর ‘একুশের স্মৃতি ও ভাবনা’, বাংলার বরেণ্য কথাশিল্পীদের গল্পের সংকলন ‘একুশের ২১ গল্প’। বইটি সম্পাদনা করেছেন কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক। একই প্রকাশনী বের করেছে ভাষা আন্দোলনের দুই অগ্রসৈনিক শহীদ মুনীর চৌধুরীর ‘দুষ্প্রাপ্য রচনা’ এবং শহীদ জহির রায়হানের ‘আত্মকথা ও অন্যান্য রচনা’। এ দুটি গ্রন্থের সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন কাজী জাহিদুল হক। আগামী প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে সুজন বড়ুয়ার ‘আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি : আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ বইটি। বেঙ্গল পাবলিকেশন্স বের করেছে ভাষা আন্দোলনের ঘটনা অবলম্বনে মনি হায়দারের ‘ফাগুনের অগ্নিকণা’ উপন্যাস। 

বাংলা একাডেমির তথ্য বলছে, এবারের মেলায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই এসেছে ৪০টি। সুবর্ণ প্রকাশনী থেকে এসেছে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ‘১৯৭১ : বিশ্ব জনমত তৈরিতে শরণার্থীর ভূমিকা’। ঐতিহ্য প্রকাশ করেছে আফসান চৌধুরীর ‘১৯৭১ : আন্তর্জাতিক পরিসর’ বইটি। রফিকুর রশীদের ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্পসমগ্র’ প্রকাশ করেছে আগামী প্রকাশনী। সুজন বড়ুয়ার ‘সূর্য উঠার সময়’ বইটিও এসেছে একই প্রকাশনী থেকে। জার্নিম্যান বুকস প্রকাশ করেছে বীরপ্রতীক আলমগীর সাত্তারের বয়ানে ‘কিলোফাইট’, ফারুক আলমগীরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্মৃতিকথন ‘ঢাকা টিভি স্টেশনের অবিস্মরণীয় দিনগুলো’। কথাপ্রকাশ থেকে বের হয়েছে মিলন কুমার দেবের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী’ ও সালেক খোকনের ‘১৯৭১ : খেতাবপ্রাপ্ত ত্রিশ বীর’। আগামী প্রকাশনী থেকে এসেছে ড. এম আলীমের ‘বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ’, সুজন বড়ুয়ার ‘মুক্তিযুদ্ধের কিশোর উপন্যাসসমগ্র’, মোনায়েম সরকারের ‘মুক্তিযুদ্ধের কত স্মৃতি কত কথা’, রফিকুর রশীদের ‘দাঁড়াবার সময়’। এ ছাড়া অনিন্দ্য প্রকাশ, হাওলাদার প্রকাশনী, তাম্রলিপি, অনন্যা, অন্বয় প্রকাশ, মিজান পাবলিশার্স, পাঠক সমাবেশ থেকেও এসেছে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বই। 

গতকাল মেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্মরণ : জামাল নজরুল ইসলাম’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিজ্ঞানবক্তা আসিফ। অধ্যাপক আবদুল মান্নানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অংশ নেন সুব্রত বড়ুয়া ও আরশাদ মোমেন। মূল বক্তব্যে বিজ্ঞানবক্তা আসিফ বলেন, ‘অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গাণিতিক, পদার্থবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং বরেণ্য কসমোলজিস্ট। ৫০ বছরের বৈজ্ঞানিক জীবনে তিনি ধ্রুপদি সব বিজ্ঞানধারার ওপর কাজ করে গেছেন। তার মধ্যে আছে কোয়ান্টাম ক্ষেত্রতত্ত্ব, আপেক্ষিকতার সূত্র, নক্ষত্রের গঠন ও মহাবিশ্ব তত্ত্ব। তবে তাঁর গবেষণার প্রধান বিষয় ছিল আপেক্ষিকতাবাদ ও মহাবিশ্বতত্ত্ব। তাঁর লিখিত ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’ গ্রন্থটি ফরাসি, ইতালীয়, জার্মান, পর্তুগিজসহ বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে বইটি পাঠ্যবই হিসেবে পড়ানো হয়।’

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, ‘অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম বড় বিজ্ঞানী হয়েও ছিলেন নিরহংকারী, অত্যন্ত আন্তরিক, সদাশয় ও সরল মনের অধিকারী একজন মানুষ। তিনি বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার স্বপ্ন দেখতেন।’

‘লেখক বলছি’ অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি আতাহার খান, কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামাল, গবেষক চৌধুরী শহীদ কাদের, লেখক ও পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল। এ ছাড়া রিকশাচিত্র প্রদর্শন বই ও সংলাপ মঞ্চে বিকেল ৫টায় ড. হাসান কবীর রচিত ও বাংলা একাডেমি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের কৃষি বই নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন

×