গণতন্ত্রের মুখোশে ভানুমতির খেল

ফ্যাসিবাদ, সিরাজ উদ্দিন সাথী
মুস্তাফা মজিদ
প্রকাশ: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০১:১৯ | আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ | ০৮:৪৫
গত শতাব্দীতে, ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফ্যাসিবাদের সূচনা হয় ইউরোপের ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনির হাত ধরে। পরবর্তীকালে মুসোলিনির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানিতে নাৎসিবাদের উত্থান ঘটে।
মূলত বাংলাদেশে ‘ছত্রিশ জুলাই’ গণঅভ্যুত্থান ও দীর্ঘ ষোলো বছরের নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসন নিয়ে গবেষক সিরাজ উদ্দিন সাথীর বই ‘ফ্যাসিবাদ– অতীত ও বর্তমান: ভারত বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট’।
ফ্যাসিবাদ গণতন্ত্রের কথা বলে ক্ষমতায় আসে বটে, তবে আসলে তা মিথ্যাচার ও ভোঁজবাজির ভানুমতির খেল। এরা সংঘবদ্ধ দস্যুর বৃহৎ পরিসরের ঐক্যবদ্ধ শক্তিসমষ্টি। গণতন্ত্রের মুখোশে জাতীয়তাবাদের কোর্তা পরে উগ্র মূর্তি ধারণ করে সাধারণ জনগণ ও বিরোধী মতাবলম্বীদের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে দেবতারূপী অপদেবতার দানবে পরিণত হয়। মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকেও ব্যবহার করে। যেমন– শেখ হাসিনা ক্ষমতায় যেতে ও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন এবং কওমি জননী উপাধি পান।
এরা এক নেতা এক দেশ এক কেন্দ্রিকতায় বিশ্বাসী। এ জন্য তারা মিথ্যার মিথ রচনা করে, নিজেদের পক্ষে মিথ্যা ও বিকৃত মনগড়া ইতিহাস রচনা করে আত্মমহিমার গুণকীর্তন করে। এ জন্য তারা দক্ষ লোক ভাড়া করে। হিটলারের এ রকম একজন জ্ঞানপাপী বুদ্ধিমান লোক ছিল জোসেফ গোয়েবলস। তার হাত ধরেই এই মিথ্যা প্রচার-প্রোপাগান্ডার গোয়েবলসীয় তত্ত্বের শুরু হয়।
ফ্যাসিবাদের মূল শত্রু সাম্যবাদীরা। জাতীয়তাবাদ থেকে এর উদ্ভব হলেও এর সর্বশেষ ধাপ ফ্যাসিবাদ। স্বভাবতই আন্তর্জাতিকতাবাদী মার্কসবাদের সঙ্গে ফ্যাসিবাদের দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ অনিবার্য। এরা একে অপরকে প্রধানতম শত্রু মনে করে। এক পক্ষ অন্য পক্ষের বিনাশ ছাড়া অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। দ্বন্দ্বের প্রধান কারণ হলো ফ্যাসিবাদ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষা করে। আর মার্কসবাদ সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে ব্যক্তিমালিকানা নয়, রাষ্ট্রের সামাজিক মালিকানার জন্য রাষ্ট্র গঠন করে বৈষম্যহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে।
লেখক সাথী তাঁর গ্রন্থে এ বিষয় বিস্তৃত করেছেন। এবং সেই সঙ্গে গত ষোলো বছরের শেখ হাসিনার মিথ্যা মিথ রচনা, দেবতারূপে তাঁর পিতৃপূজা ও আত্মপূজা, ভোটারবিহীন পাতানো নির্বাচনে অবৈধভাব ক্ষমতা দখল, রাষ্ট্রের অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন, নিষ্ঠুরতার সঙ্গে প্রজাপীড়ন, সকল বিরোধী মত ও দলকে দমন-নির্যাতন এবং হাজার হাজার মানুষের জেল-জুলুম ও গুম-খুনের কথাই তুলে ধরেছেন।
অন্যদিকে, ভারতে এক ধরনের হিন্দু মৌলবাদের উত্থানে ফ্যাসিবাদী শাসন চলছে। উগ্র হিন্দু সন্ত্রাসীরা জয় শ্রীরাম স্লোগান দিয়ে খড়্গহস্তে সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর জুলুম-নির্যাতন, জমিজমা-ঘরবাড়ি-দোকানপাট ব্যবসা-বাণিজ্য দখল ও আত্মসাৎ, মসজিদ ভেঙে হিন্দু মন্দির নির্মাণসহ ফ্যাসিবাদী কায়দায় মুসলিম নিধনে বিজিপি তার নির্মমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে, যার বর্ণনা লেখক তাঁর এ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
সবশেষে মহান আগস্টে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার ভারতে পলায়ন ও জনতার যে ঐতিহাসিক বিজয়, সেই বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে সর্বস্তরের মানুষের রাজপথে নেমে এসে আনন্দ-উল্লাস প্রকাশের মধ্য দিয়ে গ্রন্থের যবনিকা টানা হয়েছে।
’২৪-এর গণঅভ্যুত্থান কোনো সুসংগঠিত বিপ্লবী সর্বহারা পার্টির নেতৃত্বে ঘটেনি। যেমনটি ঘটেছিল সোভিয়েত রাশিয়ায় [১৯১৭], চীনে [১৯৪৯] ও কিউবায় [১৯৫৩]। বাংলাদেশে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে অতীষ্ঠ ও বিক্ষুব্ধ বিস্ফোরণোন্মুখ স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-জনতার ধনুর্ভঙ্গ প্রতিরোধের মুখে হাজারো শহীদের রক্তের বিনিময়ে ফ্যাসিবাদী দানবের পতন এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনা তাঁর মিত্র ভারতে পালাতে বাধ্য হওয়া বিশ্বের ইতিহাসেই নজিরবিহীন।
যদিও এই গণঅভ্যুত্থানের লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট নয়। তবে আশা করা যায়, গণমুক্তির বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার এ লড়াই চলমান থাকবে এবং অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষ একদিন ঐক্যবদ্ধ সর্বহারা শ্রেণির নেতৃত্বে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বা সশস্ত্র বিপ্লব ঘটিয়ে ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার উৎখাত করে জনগণের সামাজিক মালিকানার জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করবে।
ফ্যাসিবাদের ইতিহাস ও ষোলো বছরের হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের বীভৎসতার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা জানার জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী এ বইয়ের পাঠ খুবই জরুরি। এই প্রজন্মের পাঠকরা, যারা ফ্যাসিবাদের নাম শুনেছেন, ফ্যাসিবাদের ইতিহাস খুব একটা জানেন না এবং ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে কম জানেন, তাদের জন্য এ বই অবশ্যপাঠ্য হতে পারে।
ফ্যাসিবাদ : অতীত ও বর্তমান : ভারত বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট ।। সিরাজ উদ্দিন সাথী ।। গবেষণা ।। প্রকাশক : অ্যাডর্ন পাবলিকেশন ।। প্রচ্ছদ : মৌরিতানিয়া যোহরা ।। পৃষ্ঠা: ১০৮ ।। মূল্য: ২৫০ টাকা
মুস্তাফা মজিদ, কবি ও গবেষক
- বিষয় :
- বইমেলা