ঢাকা মঙ্গলবার, ০৮ জুলাই ২০২৫

গভীর তদন্তে ভিন্ন ফল

গভীর তদন্তে ভিন্ন ফল

ইন্দ্রজিৎ সরকার

প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ | ১৪:২১

রাজধানীতে বাংলাদেশ রেলওয়ের অডিট অফিসে চাকরি করতেন জুয়েল শেখ। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি রাতে তিনি গ্রামের বাড়ি যান। বাস থেকে নামেন পিরোজপুর-নাজিরপুর আঞ্চলিক সড়কের পাশে। পরদিন সকালে স্থানীয় পূর্ব কদমতলার ঈদগাহ ময়দানের পাশে গলায় জ্যাকেটের রশি দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় পাওয়া যায় তাঁর ঝুলন্ত লাশ। পাশেই ছোট গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিল তাঁর জ্যাকেট। এ ঘটনায় পিরোজপুর সদর থানায় হত্যা মামলা করেন তাঁর বাবা। প্রাথমিকভাবে হত্যা মনে করা হলেও তদন্তে প্রমাণিত হয়, জুয়েল আত্মহত্যা করেছেন।

আবার ঢাকার ওয়ারীর গোয়ালঘাট লেনের বাসায় মেলে রেশমা আক্তার নামের এক কিশোরী গৃহবধূর লাশ। দাম্পত্য কলহের জের ধরে তিনি সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন বলে দাবি স্বামীর। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও এই মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে মত দেন। এর ভিত্তিতে থানা পুলিশ অভিযোগপত্র দেয়। তবে অধিকতর তদন্তে দেখা যায়, তাঁকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল।

এভাবে অনেক মামলার তদন্তে বেরিয়ে আসছে এজাহার বা প্রাথমিক অভিযোগের পুরোপুরি বিপরীত ছবি। তদন্ত-সংশ্নিষ্টরা বলছেন, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় বা বাদী যে অভিযোগ করেন, তা-ই এজাহারে লেখা হয়। অনেক সময় প্রথম তদন্তে কিছু বিষয় দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। পরে তদন্তে নানা রকম তথ্য বিশ্নেষণ, বিভিন্ন পরীক্ষার প্রতিবেদন পর্যালোচনা ও যুক্তি-প্রমাণ মিলিয়ে দেখা যায় ঘটনা ভিন্ন। সম্প্রতি এমন কিছু মামলা তদন্ত করে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

পিবিআইপ্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার সমকালকে বলেন, একটি মামলার রহস্যভেদ করতে ঘটনার ভেতরে ঢুকতে হয়; যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে এগোতে হয়। কখনও কখনও দেখা যায়, প্রথম তদন্তকারী কিছু বিষয় মিস করে যান। যতটা গভীরে যাওয়ার দরকার ছিল, ততটা যাননি; হয়তো দায়সারাভাবে কাজটি করেছেন। শুধু রহস্য উদ্ঘাটন করলেই হবে না, তা প্রমাণ করতে হবে। বাদী হয়তো অভিযোগ করলেন হত্যা। কিন্তু সেটির তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করতে গিয়ে দেখা গেল আলাদা। তিনি বলেন, প্রাথমিক অভিযোগ বা এজাহারের বক্তব্যের সঙ্গে তদন্তের ফারাক হওয়ার আরেকটি কারণ আছে। সেটি হলো জেনেবুঝে ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা। আবার কখনও বাদী প্রকৃত ঘটনা না জানার কারণেও এজাহারে ভুল তথ্য দিয়ে দেন।

যেভাবে বদলে গেল জুয়েল হত্যা মামলা: পিবিআইর এসআই সুদীপ্ত শংকর বিশ্বাস জানান, জুয়েল খান ঘটনার দুই-তিন দিন আগে থেকে উদ্বিগ্ন ও মানসিকভাবে অবসাদগ্রস্ত ছিলেন। ঠিকমতো খেতেন না; ঘুমাতে পারতেন না। এসব কথা তাঁর সহকর্মীরা বলেছিলেন। গত বছরের ২৭ জানুয়ারি বিকেলে হঠাৎ তিনি দাদির অসুস্থতার কথা বলে ছুটি নিয়ে ঢাকা থেকে পিরোজপুরগামী বাসে ওঠেন। পরদিন তাঁর লাশ পাওয়া যায়। রেলওয়ে অডিট অফিসে এমএলএসএস পদে চাকরি স্থায়ী হওয়ার আশায় ছিলেন তিনি। তবে ওই প্রতিষ্ঠানে এমন কোনো পদ্ধতি না থাকায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন।

জুয়েলের বড় বোন রুমা আক্তার জানান, তিন-চার মাস আগে তাঁর ভাই জানিয়েছিলেন, দুই মাস বেতন পাচ্ছেন না। চাকরি স্থায়ী না হওয়া পর্যন্ত তাঁর শান্তি নেই। ছোট বোন মুক্তা আক্তার জানান, ঘটনার দুই-তিন দিন আগে ভাই তাঁকে ফোন করে বলেন- 'আমি যদি কোনো ভুল করে থাকি, তবে ক্ষমা করে দিস।' সেনাবাহিনীতে কর্মরত এক মামাকে ফোন করেও তিনি ভুলত্রুটির জন্য ক্ষমা চেয়েছিলেন। তিনি বিয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করলেও পরিবারের লোকজন ছিল উদাসীন। সে সঙ্গে তার আগে ছোট ভাইকে বিয়ে করানোর বিষয়টি তাঁকে কষ্ট দেয়। ঘটনাস্থলে তাঁর টাকা ও মূল্যবান সামগ্রী পড়ে থাকায় বোঝা যায়, ছিনতাইকারীর হাতে মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেনি। সব তথ্য-প্রমাণ ও যুক্তির ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া যায়, ব্যক্তিগত হতাশা থেকে তিনি আত্মহত্যা করেন।

'বাঁচাও' চিৎকারে তদন্তে বাঁক: প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে বিয়ের পর কিশোরী রেশমা তাঁর স্বামী রবিন হোসেনের সঙ্গে ওয়ারীর গোয়ালঘাট লেনের বাসায় থাকতেন। ২০২০ সালের ২৮ জুন রাতে তাঁর বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শুনে লোকজন এগিয়ে যান। অনেকক্ষণ ডাকাডাকির পর রবিন দরজা খোলেন। তখন সিলিং ফ্যানের সঙ্গে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় রেশমার লাশ ঝুলতে দেখা যায়। এ ঘটনায় তাঁর বাবা হত্যার অভিযোগ করলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে আত্মহত্যা বলে মত দেওয়া হয়।

পিবিআইর পরিদর্শক রওশন আলী বলেন, অধিকতর তদন্তে নেমে ভুক্তভোগীর মৃত্যুপূর্ব 'বাঁচাও বাঁচাও' চিৎকারকে গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়া হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানের মতে, আত্মহত্যার আগমুহূর্তে কারও পক্ষে ওভাবে চিৎকার করা সম্ভব নয়। এরপর সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, আত্মহত্যার ক্ষেত্রে মৃতের কাঁধের হাড়ের যেভাবে স্থানচ্যুতি হয়, এখানে তা হয়নি। অভিযুক্ত রবিন ১০-১৫ মিনিট পর দরজা খোলার কারণ হিসেবে বলেন, তিনি ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলেন। অথচ তাঁর দেওয়া তথ্য যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়, সংশ্নিষ্ট ফার্মেসি থেকে তিনি ওষুধ কেনেননি। আর ঘুম থেকে উঠে লাশ ঝুলতে দেখে তাঁর বিকট চিৎকার করার কথা। তবে তিনি কাঁদতে কাঁদতে দরজা খুলে দেন। এতে বোঝা যায়, তিনি জেগেই ছিলেন এবং হত্যার পর লাশ ঝুলিয়ে রাখতেই তাঁর সময় খরচ হয়। সব মিলিয়ে প্রমাণিত হয়, দাম্পত্য কলহের জের ধরে তিনি স্ত্রীকে হত্যা করেন।

পোড়া মোবাইল ফোনের সূত্রে মৃত্যুর রহস্যভেদ: বরিশালের গৌরনদীর পূর্ব চর সরিকলে গত বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি নিজের বাড়ির রান্নাঘরে দুলাল চন্দ্র সিকদারের লাশ পাওয়া যায়। তাঁর নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে ছিল। উচ্চ রক্তচাপের রোগী হওয়ায় তিনি অসুস্থ হয়ে মারা যান বলে ধারণা করা হয়। এ ঘটনায় গৌরনদী থানায় অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়।

পিবিআই বরিশাল জেলা ইউনিটের এসআই প্রতুল কুমার শীল বলেন, দুলালের ব্যবহূত মোবাইল ফোনের সর্বশেষ অবস্থানের সূত্র ধরে কালাম দালালের বাড়িতে যায় পুলিশ। সেখানে তাঁর ঘরের পেছনে ছাই ফেলার স্থানে পোড়া অবস্থায় ফোনটি পাওয়া যায়। অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কালাম ফোনটি তাঁর ভাতিজি সোনিয়াকে দিয়েছিলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে তিনি হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে ফিরে ফোনটি কেড়ে নিয়ে আছড়ে ভেঙে ফেলেন। পরে সেটি চুলার আগুনের মধ্যে ফেলে দেন। পোড়া মোবাইল ফোনটি শেষে ছাইয়ের স্তূপে ফেলে দেওয়া হয়। কালামকে জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্তে জানা যায়, মৃত দুলাল সিকদার ঘটনার কয়েক দিন আগে তাঁর বাড়ির কিছু গাছ বিক্রি করে দেন। স্থানীয় স্বপন জমাদ্দার ওই গাছ কিনতে চাইলেও দামে বনিবনা না হওয়ায় তাঁর কাছে বিক্রি করেননি দুলাল। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ও কালাম মিলে মাথায় আঘাত করে এই হত্যাকাণ্ড ঘটান।

আরও দুটি ঘটনা: ২০১৯ সালের ১৩ জানুয়ারি বরগুনার বামনা থানার নাপিতবাড়ী এলাকার বাড়িতে স্বপন মৃধার মৃত্যু হয়। এর আগে ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর বিরোধের জের ধরে তাঁকে মারধর করা হয় বলে অভিযোগ করেন তাঁর বোন রহিমা। ওই আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে দাবি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়। তবে তদন্তে মারধরের কোনো প্রমাণ মেলেনি। তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পটুয়াখালীর পরিদর্শক আবদুল মতিন খান জানান, তীব্র নিউমোনিয়ার কারণে তাঁর মৃত্যু হয়।

এদিকে গত বছরের ৮ এপ্রিল রাতে পটুয়াখালীর জৈনকাঠি ইউনিয়নের ভাগিরাবাদের বাড়িতে অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ পূর্ণিমা রানী ভদ্রের লাশ পাওয়া যায়। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী হত্যা মামলা করেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই পটুয়াখালীর এসআই মিঠু রায় তদন্ত প্রতিবেদনে জানান, অভাবের যন্ত্রণা সইতে না পেরে এবং ঋণের চাপে তিনি আত্মহত্যা করেন।

'তদন্ত বিশেষায়িত সংস্থারই করা উচিত': মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক সমকালকে বলেন, 'বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে থানা পুলিশ এত কাজে নিয়োজিত থাকে যে তদন্তের জন্য যথেষ্ট সময়ও পায় না। আবার তদন্ত-সংশ্নিষ্ট অনেকেরই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নেই। সে সঙ্গে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের অভাব, জবাবদিহির ঘাটতির কারণে তাঁরা অনেক সময় দায়সারা তদন্ত করেন। গবেষণায় দেখা গেছে, দুর্বল অভিযোগপত্রের কারণে ৬০ শতাংশ মামলায় ভুক্তভোগী বিচার পান না। আর পিবিআই তো পুরোদস্তুর তদন্ত সংস্থা। তাদের সক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে প্রমাণ করার দক্ষতা থানা পুলিশের কাছে আশা করাও ঠিক নয়। আমি মনে করি, তদন্ত বিশেষায়িত সংস্থারই করা উচিত। আর থানা পুলিশ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখবে।'

অবশ্য সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক মনে করেন, কেস টু কেস বিশ্নেষণ না করে, থানা পুলিশের তদন্তে গাফিলতি রয়েছে- সার্বিকভাবে এমন মন্তব্য করা ঠিক হবে না। মামলা যেহেতু থানায় হয়, প্রথম তদন্ত তো তারাই করবে। সব সময় তো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় না। হয়তো প্রথম তদন্ত কর্মকর্তার সময় এভিডেন্স পাওয়া যায়নি, পরে গেছে। আবার বাদীও অনেক সময় চান যে অন্য সংস্থা তদন্ত করুক।

আরও পড়ুন

×