ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

কারওয়ান বাজারের বিদায়ী সুর কতদূর

কারওয়ান বাজারের বিদায়ী সুর কতদূর

কোলাজ

অমিতোষ পাল

প্রকাশ: ২৮ মার্চ ২০২৪ | ০৭:৩৬ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪ | ১১:১৩

নগরের সবচেয়ে বড় পাইকারি আড়ত কারওয়ান বাজারকে বলা হয় ঢাকার ‘হৃৎপিণ্ড’। জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ– কী নেই এখানে! গমগম করা মানুষের ভিড়ে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে দিনের চেয়ে রাতেই প্রাণ ফেরে এই বাজারে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী কারওয়ান সিং প্রথম এখানে ব্যবসা পেতে বসেন। তাঁর নামেই বাজারটির নামকরণ।

এখানেই দাঁড়িয়ে আছে পাঁচতারকা হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রীয় অতিথি ও খেলোয়াড় ঢাকায় এলে ওঠেন এই হোটেলে। জাতীয় অনেক অনুষ্ঠানও হয় সোনারগাঁওয়ে। সেখানে যোগ দেন প্রধানমন্ত্রীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা। নিরাপত্তা এবং কারওয়ান বাজারের ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ভবন ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের কারণে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন ২০০৪ সালে প্রথম এ বাজার স্থানান্তরের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ জন্য মহাখালীতে তৈরি করা হয় বিশাল মার্কেট। তবে সে সময় বেঁকে বসেন ব্যবসায়ীরা। পরে আরেকটি মার্কেট গড়ে তোলা হয় গাবতলীতে। নানামুখী তৎপরতায়ও ব্যবসায়ীদের এখনও গাবতলীর পথে হাঁটানো যায়নি।

সবশেষ গেল ১৮ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে মেয়র ঘোষণা দেন, পর্যায়ক্রমে কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি দোকানপাট সরিয়ে নেওয়া হবে। ঈদুল ফিতরের পর প্রথম ধাপে পাইকারি ও খুচরা আড়ত নেওয়া হবে গাবতলীতে। এ ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক কেউ কিছু না বললেও এখনই আড়তদাররা কারওয়ান বাজার ছাড়তে চাইছেন না। 

প্রথমে সরবে ১৭৬ আড়ত

প্রথম ধাপে ১৭৬ আড়তের সঙ্গে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব জায়গায় থাকা ১৮০ দোকান স্থানান্তরের প্রস্তুতি নিয়েছে ডিএনসিসি। পর্যায়ক্রমে কিচেন মার্কেটসহ সিটি করপোরেশনের চারটি মার্কেট স্থানান্তর করা হবে। এ মার্কেটগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে অনেক আগেই চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এসব মার্কেটের কোনোটিরই বয়স ৫০ পেরোয়নি। সাধারণত কোনো ভবন তৈরি হলে সেটির আয়ুষ্কাল ১০০ বছর ধরা হয়। তাহলে এত আগেই কেন সেগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ল, তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। অভিযোগ আছে, এসব মার্কেট তৈরির সময় সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও ঠিকাদার যোগসাজশ করে অনিয়ম করায় মার্কেটগুলো মানসম্পন্নভাবে তৈরি হয়নি। এগুলো হচ্ছে– কিচেন মার্কেট, ১ নম্বর ভবন মার্কেট, ২ নম্বর ভবন মার্কেট ও কাঁচামালের আড়ত মার্কেট। অবশ্য এ নিয়ে বর্তমানের কর্মকর্তারা কিছু বলতে নারাজ। ওই সময় কারা দায়িত্বে ছিলেন, তাও জানেন না তারা।

গাবতলী কতটা প্রস্তুত

গাবতলী থেকে বেড়িবাঁধ দিয়ে রায়েরবাজারের দিকে কিছুদূর এগোলেই পূর্ব দিকে ডিএনসিসির একটি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ ও কার্যালয় রয়েছে। ডিএনসিসির ব্যবহৃত গাড়িগুলো সেই ওয়ার্কশপে মেরামত করা হয়। ওয়ার্কশপের চৌহদ্দির মধ্যেই তৈরি করা হয়েছে একটি দোতলা মার্কেট। সেই মার্কেটেই স্থানান্তর করা হবে কারওয়ান বাজারের আড়ত।

সরেজমিনে দেখা গেছে, মার্কেটটিতে ৫০ থেকে ১০০ বর্গফুটের বিভিন্ন ধরনের কয়েকশ দোকান আছে। সামনে রয়েছে শাটার। দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় সেগুলো অনেকটা বিবর্ণ। আড়ত স্থানান্তরের ঘোষণার পর সেগুলোতে রংচং করা হচ্ছে। এসব দোকানে আড়তদারি হবে না বলে জানাচ্ছেন আড়তদাররা। অবশ্য এ প্রসঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ডিএনসিসির নির্বাহী প্রকৌশলী নাঈম রায়হান বলেন, বিদেশেও তো পাইকারি মার্কেট আছে। সেখানে তো কারওয়ান বাজারের মতো মাটিতে পণ্য বসিয়ে আড়তদারি চলে না।

এসব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মেহেদী আহসান বলেন, এ ধরনের কাজ করতে গেলে কমিউনিটি প্ল্যানিং করতে হয়। যারা ব্যবহার করবে তারা থাকবেন, স্থপতিরা থাকবেন, দায়িত্বশীল সংস্থা বা সরকারের কর্মকর্তারা থাকবেন। তারপর সবাই মিলে নকশা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি। এমনিতেই বাংলাদেশে বদ্ধঘরে নকশা করা হয়। লোকজন পকেটে নকশা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, জনগণকে দেখায় না। সেটি দেখালেও ভুলগুলো ধরা পড়ে। এ কারণেই ভুল পরিকল্পনায় মার্কেট হয়েছে। 

রাতে ঘুমায় না কারওয়ান বাজার

কারওয়ান বাজারে আছে ৯টি মার্কেট। সিটি করপোরেশন ১ ও ২ নম্বর মার্কেট, কিচেন মার্কেট, আড়ত ভবন, কারওয়ান বাজার কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেট, কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেট, কারওয়ান বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেট, আম্বর শাহ ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেট এবং কারওয়ান বাজার মৎস্য আড়ত ব্যবসায়ী সমিতি মার্কেট। এসব মার্কেটে দোকান প্রায় আড়াই হাজার। ১৭৬টি আছে কাঁচামালের আড়ত। মাছ-মাংস, শাকসবজি থেকে শুরু করে কাপড়চোপড়, মোবাইল ফোন, ঘড়ি, তালা-চাবি, দা-চাপাতি সবই মেলে কারওয়ান বাজারে। এসব ব্যবসায় জড়িত ১০ হাজারের মতো মানুষ।

দিনে যেমন জমজমাট থাকে, তেমনি রাতে ঘুমায় না কারওয়ান বাজার। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাছ, শাকসবজি, ফলমূল, চাল, ডাল, পেঁয়াজ-রসুনের ট্রাক ঢোকে এ বাজারে। ভোরের আগেই খুচরা বিক্রেতারা পণ্য কিনে ভ্যানে কিংবা ছোট ট্রাকে চেপে ছোটেন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। এ ছাড়া খুচরা ক্রেতাদেরও কেনার সুযোগ রয়েছে। কারওয়ান বাজার ঘিরে প্রতিদিন হয় কোটি কোটি টাকার কেনাবেচা। নগরের প্রাণকেন্দ্র হওয়ায় কোনো ব্যবসায়ী কারওয়ান বাজার ছাড়তে চান না। এখানে আছে চাঁদাবাজির একটি বড় সুবিধাভোগী পক্ষ। তারাও কারওয়ান বাজার টিকিয়ে রাখতে চায়। 

ক্রেতারা যাবে কোথায়

প্রতিদিন কারওয়ান বাজারে কত মানুষ কেনাকাটা করতে যান, এর সঠিক হিসাব না থাকলেও এ সংখ্যা লাখ ছাড়াতে পারে। শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস সবই তারা কেনেন। কারওয়ান বাজার স্থানান্তর হলে তারা কোথায় বাজার করবেন? আবার যেসব খুচরা ব্যবসায়ী কারওয়ান বাজার থেকে কিনে আশপাশের বাজারগুলোতে বিক্রি করেন, তাদেরও ছুটতে হবে গাবতলী। এতে পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

ইস্কাটনের দিলু রোডের বাসিন্দা সাবেরা ইসলাম বলেন, ‘আমার বাসার আশপাশে মাছ-মাংস-সবজির দোকান থাকলেও সেখানে দাম বেশি। এ জন্য হেঁটে কারওয়ান বাজার যাই। সেখান থেকে অনেক সস্তায় জিনিসপত্র কেনা যায়। এতে বেশ আর্থিক সাশ্রয় হয়। কারওয়ান বাজারের আড়ত গাবতলীতে গেলে আমার মাসে অন্তত দুই হাজার টাকা খরচ বেড়ে যাবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।’ 

তেজকুনিপাড়ার কামিলুস গান্ধাই বলেন, ‘খরচ কমানোর জন্য আমরা কয়েকটি পরিবার মিলে একসঙ্গে কারওয়ান বাজার থেকে পাইকারি দরে মাছ-তরকারি কিনে ভাগ করে নিই। এতে অনেক খরচ কমে যায়। কারওয়ান বাজার অন্যত্র চলে গেলে এ সুযোগ বন্ধ হয়ে যাবে। গাবতলী গিয়ে কিনে আনা তো আর সম্ভব হবে না।’

এ ব্যাপারে ডিএনসিসির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শরীফ উদ্দিন বলেন, হাতিরপুল, কাঁঠালবাগান, তেজগাঁওয়ের কলমীলতা বাজার আছে। সেখানে তারা কেনাকাটা করতে পারবেন। ফলে কারওয়ান বাজার স্থানান্তর হলে কোনো সমস্যা হবে না। আর মানুষ যাতে মানিয়ে নিতে পারে, এ জন্য ধাপে ধাপে স্থানান্তর করা হবে। প্রথম ধাপে যাবে আড়ত। আর আড়তদাররা যে ব্যক্তিগত আড়ত উচ্ছেদের দাবি করছে, সেগুলোও উচ্ছেদ করার কথা মেয়র জানিয়েছেন। 

বাণিজ্যিক হাব হবে কারওয়ান বাজার

কারওয়ান বাজারের দোকানগুলো স্থানান্তরের পর সেখানে কী হবে, তার চূড়ান্ত নকশা না হলেও ডিএনসিসির তরফ থেকে বলা হচ্ছে, কারওয়ান বাজারকে আধুনিক একটি বাণিজ্যিক হাব হিসেবে গড়ে তোলা হবে। সেখানে একটি পাঁচতারকা হোটেলও হতে পারে। দৃষ্টিনন্দন বহুতল ভবন তৈরি করে সেগুলোতে গড়ে তোলা হতে পারে আইটি ব্যবসা কেন্দ্রও। থাকতে পারে বেসরকারি অফিসও।

কারওয়ান বাজারে ডিএনসিসির জমির পরিমাণ সাড়ে ২৪ বিঘা, যার বাজারদর সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে ডিএনসিসি কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব পায় না। বাণিজ্যিক হাব তৈরি করা গেলে এ খাত থেকে ডিএনসিসির আয় অনেক বাড়বে। সেই অর্থ দিয়ে নগরবাসীকে উন্নত সেবা দিতে পারবে। নিজের পায়ে শক্তভাবে দাঁড়ানোর পাশাপাশি সরকার বা বিদেশি অনুদান-ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে।

কারা কী বলছেন

কারওয়ান বাজার ক্ষুদ্র কাঁচামাল আড়ত ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, গাবতলীতে যেখানে আড়ত স্থানান্তরের কথা বলা হচ্ছে, সেখানে আড়তদাররা যাবেন না। কারণ, সেখানে আড়ত ব্যবসা করার উপযোগী করে অবকাঠামো তৈরি হয়নি। কাঁচামালের আড়তদারি শাটারের মধ্যে হয় না। দ্বিতীয়ত, গাবতলীর আশপাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন মাজার রোড, দিয়াবাড়ী ও বেড়িবাঁধে কাঁচামাল আড়ত রয়েছে। সেখানে এত আড়ত থাকলে গাবতলী আড়তে কেন ক্রেতা আসবে? স্থানান্তর করতে হলে আগে ব্যক্তিমালিকানাধীন আড়তগুলো উচ্ছেদ করতে হবে।

কারওয়ান বাজার খুচরা আড়ত মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলাম বলেন, সিটি করপোরেশনের অফিসের ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। তারা সেটি ভেঙে ফেলতে চায়। সেখানকার আড়তদাররা গাবতলী যেতে পারে। অন্যরা কেন যাবে?

এ ব্যাপারে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বিদেশিদের সুন্দর ভিউ দেওয়ার জন্য কাঁচাবাজার সরে যাবে– এটি হতে পারে না। বস্তি থাকলে তারা সেটি দেখুক। কসমেটিক ধারণা দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না; বরং কারওয়ান বাজারের ভবনগুলো যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ, সেগুলো অপসারণ করে সেখানে একটি আধুনিক কাঁচাবাজার হতে পারে। কারণ যখন কাঁচাবাজারটি গাবতলীতে স্থানান্তর হবে, তখন জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেতে পারে।

ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খায়রুল আলম বলেন, নগরের ভেতর এ ধরনের পাইকারি আড়ত থাকতে পারে না। কারওয়ান বাজারকে স্থানান্তর করা সরকারের একটি অগ্রাধিকার প্রকল্প। এ জন্য এটিকে স্থানান্তর করতেই হবে। ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। আর যারা কারওয়ান বাজার থেকে সদাই করেন, তাদের জন্য আশপাশে বেশ কয়েকটি বাজার আছে। তারা সেখান থেকে কেনাকাটা করবেন। এসব ভেবেই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

×