নাগরিক মূল্যবোধ গঠনে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা

প্রতীকী ছবি
ড. মোহাম্মদ ফজলুর রহমান খান
প্রকাশ: ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ০৭:৫৯ | আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২০ | ০৮:০২
আমাদের যাপিত জীবনে মূল্য ধারণার ব্যবহার বহুমাত্রিক। অর্থশাস্ত্র, মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান এমনকি দর্শনশাস্ত্রেও মূল্য ধারণা সমান উপযোগিতায় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। অর্থশাস্ত্রে মূল্য বলতে সাধারণত কোনো পণ্যের বিনিময়ে মানুষ যে পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে ইচ্ছুক তাকেই নির্দেশ করে। আবার মনোবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান কিংবা দর্শনের দৃষ্টিতে মূল্যবোধ ধারণাটির মধ্যে নৈতিক ও আবেগীয় বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, যে প্রভাবশালী মনস্তাত্ত্বিক শক্তি বা বোধের কারণে বিকল্প বস্তু বা ক্রিয়াকলাপের চেয়ে মানুষ কোনো সুনির্দিষ্ট বস্তু বা কার্যক্রমকে অধিকতর মূল্যবান মনে করে তাকেই মূল্যবোধ বলে আখ্যায়িত করা যায়। বিস্তৃত পরিসরে ভাবলে দেখা যায়, সমাজ জীবনে সংঘটিত ঘটনাগুলোর সঠিকতা বা ঔচিত্যের প্রশ্নে উপলব্ধির জগতে সৃষ্ট সুনির্দিষ্ট ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে মানুষ সংশ্নিষ্ট ঘটনা সম্পর্কে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটি অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছায়। সামষ্টিক ভালোমন্দ, উচিত, অনুচিত উপলব্ধির ক্ষেত্রে চেতনে বা অবচেতনে অনুসৃত নীতিমালা বা মানদণ্ডকেই সমাজবিজ্ঞানীরা চিহ্নিত করেছেন সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে। দর্শনশাস্ত্রে মূল্য ধারণার অবতারণা হয় পাশ্চাত্য ভাববাদী দর্শনের জনক প্লেটোর হাত ধরে। তবে মূল্যবোধকে সুস্পষ্ট দার্শনিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেন নৈতিক দর্শন ঘরানার ভাববাদী দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট। ভাববাদী দার্শনিকদের মতে, মহাবিশ্বের যে কোনো বস্তু বা ঘটনা সম্পর্কে ব্যক্তি বা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিই সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজের কাছে ওই ঘটনার ভাবগত মূল্যায়নকে নির্দেশ করে। আর যে নেতিক মানদণ্ডের ভিত্তিতে ব্যক্তি বা সমাজ কোনো বস্তু বা ঘটনার বাঞ্ছিত-অবাঞ্ছিত আদর্শিক অবস্থান সম্পর্কিত সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তাকেই দার্শনিক দৃষ্টিতে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তি বা সমাজের মূল্যবোধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে অর্থে মূল্যবোধ ব্যক্তি বা সমাজের কর্মের উৎকর্ষের নির্ণায়ক।
গ্রিক দর্শনে উল্লিখিত সক্রেটিসকে বিশ্নেষণ করলে আমরা মহাজাগতিক মূল্য হিসেবে সত্য, কল্যাণ ও সুন্দরের সন্ধান পাই। দার্শনিক দৃষ্টিতে উল্লিখিত মূল্য তিনটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও শ্বাশত হওয়ায় এ মূল্যগুলোকে তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের কারণেই মানুষ প্রত্যাশা করে। তাই এই তিনটি মূল্যকে বলাহয় স্বতঃমূল্য। মানুষের চিন্তার সঙ্গে মুখনিঃসৃত বাক্য এবং বাস্তব ঘটনা বা বস্তুর সংগতিই হচ্ছে সত্য। আদর্শ মানবসমাজ গঠনে সত্য মূল্য অপরিহার্য। তাই ঝুঁকি থাকলেও সত্য প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থাকতে হবে। কল্যাণ হচ্ছে মানুষের বিচারবুদ্ধির সঙ্গে ইন্দ্রিয় কামনা-বাসনার সংগতি। যে কর্মের মধ্যে কল্যাণ নিহত থাকে, সেই কর্মই মূল্যবান। সুন্দরকে বলা হয় অনুভূতির আদর্শ। সুন্দরের বস্তুগত ভিত্তি হলো, বস্তুর বিভিন্ন অংশের মধ্যে সামঞ্জস্য এবং আকার-উপাদানের ঐক্য। গ্রিক দর্শনে সত্য, কল্যাণ ও সুন্দরকে পারস্পরিক গভীর সম্পর্কে সম্পর্কিত বলে রূপায়ণ করা হয়েছে। তবে মূল্য তিনটির মধ্যে সম্পর্ক সমপদস্থের, অধীনস্থের নয়। ব্যক্তির মধ্যে যতবেশি মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটে, স্বতঃমূল্য তিনটির পারস্পরিক সম্পর্ক ততই প্রকট হয়।
সত্য, কল্যাণ ও সুন্দর ছাড়াও এমন কিছু মানসিক মূল্য আছে, যেগুলো স্বতঃমূল্যের অর্জনকে সহজতর করে। যেমন- দৈহিক ও অর্থনৈতিক মূল্য, যাদের বলা পরতঃমূল্য। মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামে আর্থিক ও দৈহিক মূল্যের গুরুত্ব অপরিসীম। আবার সুস্থ দেহ ও সচ্ছল জীবনে সত্য ও কল্যাণের স্বরূপ যথাযথভাবে উপলব্ধি করা এবং সুন্দরভাবে কল্যাণকর কার্যসম্পাদন করা সহজতর হয়। সত্য, কল্যাণ ও সুন্দরের মূল্যকে অটুট রেখে অর্থনৈতিক ও দৈহিক স্বাবলম্বিতার দিকে অগ্রসর হলে বিকশিত হয় মানবিক সংস্কৃতির। কোনো সমাজের মূল্যবোধে স্বতঃমূল্য অর্থাৎ সত্য, কল্যাণ ও সুন্দরের যতবেশি প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়, সে সমাজ ততবেশি ন্যায়ানুগ ও শুদ্ধ বলে পরিগণিত হয় এবং উন্নীত হয় ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, ধনী, দরিদ্র নির্বিশেষে সবার জন্য বাসযোগ্য সর্বজনীন মানব সমাজে।
প্রকৃতপক্ষে মূল্যবোধে স্বতঃমূল্যের উপস্থিতিই মানুষকে প্রাণিকুলের অন্যান্য সদস্য থেকে বিশেষ মর্যাদায় উন্নীত করে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষের টিকে থাকার অভিযাত্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরতঃমূল্যের প্রাধান্য পরিলক্ষিত হয়। কখনও কখনও মানুষ যে কোনো মূল্যে অর্থনৈতিক ও দৈহিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে চায়। এ ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। কারণ মূল্যবোধের সঙ্গে সংস্কৃতির সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বলা যায় মূল্যবোধ অনেকাংশেই সংস্কৃতিনির্ভর। তাই সংস্কৃতি ও সময়ভেদে মূল্যবোধের ভিন্নতাও সুস্পষ্ট। মদ্যপান সম্পর্কে পাশ্চাত্য সমাজের মূল্যবোধ যেমন আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ থেকে একেবারেই ভিন্ন। তেমনি ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজের কন্যাশিশু বিষয়ক মূল্যবোধ এবং ইসলাম-পরবর্তী যুগের মূল্যবোধ সম্পূর্ণ পৃথক। সেই বিবেচনায় মূল্যবোধ মানব সংস্কৃতির মতোই গতিশীল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আচার,-আচরণ, রুচি, অভ্যাস এবং জীবনঘনিষ্ঠ সামাজিক বিষয়াদির বিবর্তন প্রতিফলিত হয় সংশ্নিষ্ট জনপদের সংস্কৃতিতে। আবার কোনো বস্তু বা ঘটনাকে বাঞ্ছিত বা অবাঞ্ছিত হিসেবে মূল্যায়নের বিশ্বাসগত একক তথা মূল্যবোধও বিবর্তিত হয় সংস্কৃতির প্রভাবে। পক্ষান্তরে সংস্কৃতির ওপর পরিলক্ষিত হয় পরিবর্তিত মূল্যবোধের প্রভাব। মূল্যবোধের বিবর্তন প্রক্রিয়ায় অন্যান্য প্রভাবকগুলোর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রভাবও বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নাগরিকদের যথার্থ মূল্যবোধ গঠন উপযোগী প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার নিশ্চিয়তা বহুলাংশেই নির্ভর করে রাষ্ট্রীয় শিক্ষাব্যবস্থার উৎকর্ষের ওপর। তাছাড়া ধর্ম বা সামাজিক রীতিনীতি মানব সংস্কৃতির বহুবিধ উপাদানের সঙ্গে যেমন নিবিড়ভাবে সংশ্নিষ্ট, তেমনি মূল্যবোধ গঠনেও ক্রিয়াশীল। কারণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বহুলাংশেই ধর্মীয় বিধিনিষেধ ও সামাজিক রীতিনীতি নির্ভর। তথাপি জনগোষ্ঠীর যাপিত জীবনে এসব উপাদানের কার্যকর প্রভাব রাষ্ট্রাচার তথা সংশ্নিষ্ট রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও শাসন বিভাগের কর্মপরিকল্পনা, কর্মসম্পাদন প্রক্রিয়া এবং জবাবদিহিতার সুযোগ ইত্যাদি বিষয়ের ওপর নির্ভর করে।
কারণ শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্মীয় অনুশাসনের বদৌলতে নাগরিকরা উপযুক্ত মূল্যবোধের পাঠ গ্রহণের পরও নেতিবাচক রাষ্ট্রাচারের প্রভাবে তা নেহায়েতই পুঁথিগত বিদ্যায় পরিণত হতে পারে। যেমন- মিথ্যা বলা বা ঘুষ গ্রহণ অপরাধ- এ জাতীয় নৈতিক শিক্ষা গ্রহণের পর যদি কোনো নাগরিক রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপকদের মধ্যে মিথ্যাচারের বৈশিষ্ট্য প্রত্যক্ষ করেন বা ঘুষের বিরুদ্ধে কঠোর রাষ্ট্রীয় অবস্থানের পরিবর্তে শিথিলতা প্রত্যক্ষ করেন সে ক্ষেত্রে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তির কাছে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক নৈতিক শিক্ষার মনস্তাত্ত্বিক মূল্য হ্রাস পায়। কারণ রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে যখন সততা, দক্ষতা ও নিষ্ঠার চেয়ে তোষামোদ, পেশিশক্তি এবং ব্যক্তি বা গোত্রীয় অনুগত্য সফলতার মানদণ্ডে পরিণত হয় তখন মানুষের কাছে সত্য, কল্যাণ ও সুন্দরের মতো স্বতঃমূল্যের চেয়ে পরতঃমূল্য অর্থাৎ অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠা লাভের সুযোগ মুখ্য হয়ে ওঠে।
এ ক্ষেত্রে মানুষ ব্যক্তিগত নিরাপত্তাহীনতা কাটাতে যে কোনো উপায়ে অর্থনৈতিক সফলতা ও সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়াকেই মূল্যবান মনে করে। ফলে স্বতঃমূল্যের পরিপূর্ণ পাঠ নেওয়ার পরও একজন নাগরিক পুরোদস্তুর মিথ্যাবাদী, তোষামোদকারী বা ঘুষখোরে পরিণত হতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় সুশাসন যেমন সুনাগরিক তথা যথাযথ মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গঠনে সহায়ক, তেমনি নেতিবাচক রাষ্ট্রাচার নাগরিকদের মূল্যবোধকে নেতিবাচকভাবেই প্রভাবিত করে। তাই আধুনিক কালে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই মূল্যবোধ বিবর্তনের অন্যতম প্রভাবক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
- বিষয় :
- নাগরিক মূল্যবোধ