জনকের প্রত্যাগমন

মো. শরীফ মাহমুদ অপু
প্রকাশ: ০৯ জানুয়ারি ২০২১ | ১২:৪৩ | আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০২১ | ০৪:৫৩
১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান নামে একটি ডেড চাইল্ড আমরা পেয়েছিলাম। এ ডেড চাইল্ডটিকে দাফন-কাফন করে স্বাধীন বাংলাদেশ পেতে আমাদের ২৩ বছর লেগেছিল। স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন সামনে নিয়ে দীর্ঘ ২৩টি বছর জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনা করে, নিজের জীবন উৎসর্গ করে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন যে, শুধু ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রায় ১২শ মাইল দূরত্বের ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ভাবধারার দুটি ভূখণ্ডকে এক করে নিষ্পেষণ করে এক দেশ করে রাখা যায় না।
'৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে বিজয় অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে ত্বরান্বিত করে। পাকিস্তানিরা আলোচনার নাম করে পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সংখ্যা বাড়াতে থাকে। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে কী হতে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু '৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মূলত স্বাধীনতারই ডাক দেন। ইউনেস্কো কর্তৃক স্বীকৃত তার এ ভাষণটি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভাষণের মধ্যে অন্যতম। তিনি এ ভাষণে জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে দেন, বাঙালিকে কখন কী করতে হবে। এই ভাষণে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। স্বাধীনতা সংগ্রাম ছাড়া বাঙালির আর কিছুই করার ছিল না। বঙ্গবন্ধু গঠনমূলক আন্দোলনের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে গেছেন। তিনি নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিশ্ব ও বাংলাদেশের জনগণের কাছে মুক্তিসংগ্রামের পটভূমি তুলে ধরেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে এবং ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় বাঙালির চূড়ান্ত বিজয়, সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন 'স্বাধীনতা'। ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাথা নত করে প্রায় ১ লাখ সৈন্য নিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ওই দিন সারাদেশের মানুষ আনন্দে জয় বাংলা স্লোগানে একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিল। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পর থেকে ইতিহাস বিকৃতির অনেক রকম চেষ্টা করা হয়েছে। এ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছে; ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্যমহানি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের মানুষ ৯ মাস পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। দেশপ্রেমের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকেই সব কিছু ফেলে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এ দেশের মানুষ। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় এলেও জনগণ বিজয় উদযাপন করতে পারছিল না। মুক্তিযোদ্ধা তথা আপামর জনসাধারণ অপেক্ষা করছিলেন বঙ্গবন্ধু কবে দেশে ফিরে আসবেন। এদেশের জনগণ তখন গভীর আগ্রহ ও উৎকণ্ঠা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে পাওয়ার জন্য দিনক্ষণ গুনছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে আসেন।
পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু মোট তিন হাজার তিপ্পান্ন দিন জেলে কাটিয়েছেন। মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিলেন দুই বার। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান সরকার জেলে প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন করত। তাকে পাগলাগারদের কাছে কোনো কক্ষে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু তার সমগ্র জীবন বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য উৎসর্গ করে গেছেন। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২ পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। বঙ্গবন্ধু ৯ জানুয়ারি পাকিস্তান থেকে সরাসরি বাংলাদেশে না এসে লন্ডন যান। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দেন এবং দুই নেতা বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন।
লন্ডন থেকে ঢাকা আসার পথে বঙ্গবন্ধু দিল্লিতে যাত্রাবিরতি করলে দিল্লিতে তাকে বিপুল সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে দিল্লি বিমানবন্দরে স্বাগত জানান। দিল্লিতে তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু বিশাল এক জনসভায় বাংলায় বক্তব্য দেন। বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতা ছিলেন বলেই মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সর্বাধিক সহযোগিতার জন্য তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, বিভিন্ন দলের নেতা ও ভারতের জনগণকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের পাশাপাশি সেই সঙ্গে ভারতীয় সৈন্য ফেরত নেওয়ার বিষয়েও কথা বলে আসেন। ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লি থেকে বিশেষ বিমানে বঙ্গবন্ধু ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। সকালেই তেজগাঁও বিমানবন্দরে লাখো মানুষ জমায়েত হয়। এদিকে রেসকোর্স ময়দান ভরে যায় লাখো মানুষে। বিমানবন্দরে নেমেই তিনি রেসকোর্স ময়দানে আসেন। রেসকোর্স ময়দানে নেমেই সমবেত জনতার উদ্দেশে ভাষণ দেন, যেটি তার ৭ মার্চের ভাষণের মতোই মূল্যবান।
তিনি চোখ মুছে বলেন, 'আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের স্বাধ আজ পূর্ণ হয়েছে। আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে।' তিনি আরও বলেন, 'বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে; আমি কারাগারে বন্দি ছিলাম, ফাঁসির কাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে কেউ দাবায় রাখতে পারবে না।'
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে আসার মাধ্যমে বাংলাদেশের বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। স্বদেশের মাটি স্পর্শ করে আনন্দ-বেদনার অশ্রুধারা নামল বাংলাদেশের ইতিহাসের নির্মাতার চোখ বেয়ে। প্রিয় নেতাকে ফিরে পেয়ে সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালি আনন্দাশ্রুতে সিক্ত হয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান দিয়ে প্রকম্পিত করে তোলে বাংলার আকাশ-বাতাস। জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের একটি মানচিত্র দিয়েছেন, দিয়েছেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তার উপহার দেওয়া বাংলাদেশ আজ তার যোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বিশ্বে আজ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু কন্যার নেতৃত্বে বিশ্বে বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ রাষ্ট্র।