বিশেষজ্ঞ অভিমত
বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চাই

রাশেদা কে চৌধুরী
প্রকাশ: ২২ মে ২০২১ | ১২:০০ | আপডেট: ২২ মে ২০২১ | ১৬:০৬
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় পৃথিবীর সকল দেশই কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ক্ষতি হয়েছে সকল খাতের। সেগুলো ক্রমশ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, কৃষি, শিল্প- সব খাতের ক্ষতিই তথ্য-উপাত্ত ও চোখের দেখায় দৃশ্যমান। কিন্তু শিক্ষা খাতে করোনার প্রভাব যে কত ভয়াবহ, তা এখনও পুরোপুরি দৃশ্যমান নয়। তাই এখনও তা আমরা অনুধাবন করতে পারছি না।
আমরা সরকারি-বেসরকারি নানা সূত্র ও তথ্য থেকে জানতে পারছি, করোনায় নিম্ন মধ্যবিত্ত ও দরিদ্ররা ভীষণ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছেন। বহু মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছেন। যাদের একটি নির্দিষ্ট আয়ের মধ্যে চলতে হয় তারা হিমশিম খাচ্ছেন। তবে শিক্ষার ক্ষয়ক্ষতি দৃশ্যমান না হওয়ায় এর প্রকৃত পরিণতি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করছি, তারা এ পরিস্থিতিকে শিক্ষার জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত বলে মনে করি। কারণ যদি সমস্যাটি অনুধাবনই না করা যায়, তাহলে আগামীর সঠিক পরিকল্পনা আমরা কীভাবে করব? এটিই সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয়।
তবে যে টুকু তথ্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম তুলে আনছে, তা থেকেই পরিস্কার- শিক্ষার ক্ষতি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে উঠেছে।
টানা ১৭ মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি। এই ছুটি আরও বাড়ে কিনা তা নিয়েও শঙ্কিত আমরা। কারণ, এর মধ্যে করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের কথাও বলা হচ্ছে। গণসাক্ষরতা অভিযানের গত নভেম্বর-ডিসেম্বরের জরিপ থেকে আমরা মোটা দাগে চারটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় খুঁজে পেয়েছি।
প্রথমত, দীর্ঘকাল শিখন প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় শিশুরা শিখন-শূন্যতায় (লার্নিংলেস) পড়ে যাচ্ছে। এটা খুব বড় ক্ষতি। পৃথিবীর কোথাও এই শূন্যতা পূরণে কোনো আদর্শ বিকল্প তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে সরকার অনলাইন ক্লাস, বেতার ও টেলিভিশনের মাধ্যমে ক্লাস চালু করে এই শূন্যতা পূরণের চেষ্টা করছে। তবে এর সুফল সব শিক্ষার্থী পাচ্ছে না।
দ্বিতীয়ত, শিক্ষার্থীর একটা বড় অংশ ঝরে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তারা আর স্কুলে নাও ফিরতে পারে। এ বছর স্কুল ভর্তির সময়সীমা দফায় দফায় বাড়িয়েও সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। আয় না থাকায় বহু অভিভাবক পরিবার-পরিজন নিয়ে গ্রামে চলে গেছেন। ফলে তাদের সন্তানরাও স্কুলে ভর্তি হয়নি। এই শিশুরা বিদ্যালয়ে ফিরবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশে আমরা দীর্ঘ সংগ্রাম করে 'বাল্যবিয়ে' অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছিলাম। তা আবারও বাড়তে শুরু করেছে। এক সময় বাল্যবিয়ে অনেক বেশি ছিল। কিন্তু দীর্ঘ সংগ্রাম, আইন-কানুন, অভিযান ও সরকারি-বেসরকারি নানা প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে তা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল। এমন একটি বড় অর্জনের ক্ষেত্রে করোনাকালে আমরা আবারও হোঁচট খেতে যাচ্ছি।
চতুর্থত, যে বিষয়টি বলতে চাই, তা হলো খাদ্য নিরাপত্তা প্রসঙ্গ। দরিদ্র পরিবারগুলোতে আয়হীনতার কারণে অভিভাবকরা তাদের পরিবারের শিশুদের সুষম খাদ্য ও পুষ্টি এখন দিতে পারছেন না। এতে শিশু ও মাতৃ অপুষ্টির হার বেড়ে যাচ্ছে। অভিভাবকের আয়ে নিরাপত্তা না থাকলে শিক্ষাতেও তার প্রভাব পড়ে। কারণ ক্ষুধার্ত শিশুর কাছে শিক্ষা আশা করা যায় না। পুষ্টিহীনতা শিশুর শিখনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এসবের বাইরে পঞ্চম পয়েন্ট হিসেবে আমি আরও একটি কথা বলতে চাই। বেসরকারিভাবে পরিচালিত স্কুল-কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা, বিশেষ করে নন-এমপিও, কিন্ডারগার্টেন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষকরা আয় নিয়ে নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়েছেন। করোনায় শিক্ষার এসব ক্ষতি ধীরে ধীরে দৃশ্যমান হচ্ছে। অথচ ক্ষতিপূরণে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য অ্যাডহক হিসেবে কিছু শিক্ষককে এককালীন অনুদান দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। শিল্প, স্বাস্থ্য, পোশাক, কৃষি, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রে প্রণোদনা আছে। এরজন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। একইসঙ্গে বলতে চাই, শিক্ষা যেন সরকারের অগ্রাধিকার থেকে কোনোভাবেই ছিটকে না পড়ে। সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে, শিক্ষা খাতের জন্য বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ চাই। বাজেটে শিক্ষার জন্য একক খাত হিসেবে বরাদ্দ চাই। চার ভাগে ভাগ করে এই প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করতে হবে-যথা, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবক।
করোনাকাল আরও দীর্ঘ হলে শ্রেণিকক্ষের পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণিকক্ষের বাইরের পড়াশোনা তথা অনলাইন পাঠদান ও ভার্চুয়াল ডিজিটাল ক্লাসরুম আরও লাগবে।
শেষ যে কথাটি বলতে চাই তা হলো, আসছে বাজেটে শিক্ষার কোনো কিছুতেই যেন কর আরোপ করা না হয়। বিশেষ করে ডিজিটাল লেখাপড়ার কোনো উপকরণে নতুন কর বসানো যেন না হয়। নইলে এক সময় শিল্প, কৃষি ও অর্থনীতি হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারবে, শিক্ষা ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে না পারলে একটি প্রজন্মকে হয়তো আমরা হারিয়ে ফেলব। শিক্ষা থেকে তারা ছিটকে চলে যাবে বহুদূরে।
লেখক: নির্বাহী পরিচালক, গণসাক্ষরতা অভিযান, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা