ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

নেতৃত্ব

বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রার বলিষ্ঠ সারথি

বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রার বলিষ্ঠ সারথি

ড. এএইচএম মোস্তাফিজুর রহমান

প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ | ১৪:৫৩

বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পিতার স্বপ্ন গরিব, কৃষক-মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই তার রাজনীতির মূল লক্ষ্য। লক্ষ্য পূরণের স্বপ্নযাত্রায় তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে দীর্ঘপথ। সংগ্রামমুখর কর্মময় জীবন আপাদমস্তক কণ্টকাকীর্ণ। তবে সাফল্য এসে তার পায়ে লুটিয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস গৃহবন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা। সামরিক স্বৈর শাসনামলেও বেশ কয়েকবার তাকে কারা নির্যাতন ভোগ ও গৃহবন্দি থাকতে হয়েছে। বারবার তার জীবনের ওপর ঝুঁকি এসেছে। অন্তত ১৯ বার তাকে হত্যার অপচেষ্টা করা হয়েছে। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি অসীম সাহসে তার লক্ষ্য অর্জনে থেকেছেন অবিচল। তিনি পেয়েছেন দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন, নিঃশর্ত ভালোবাসা। ক্যারিশম্যাটিক ও সহজাত নেতৃত্বের মধ্য দিয়ে সময়ের পরিক্রমায় হয়ে উঠেছেন গণমানুষের নেত্রী। সফল রাষ্ট্রনায়ক; জননেত্রী। তিনি আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অ্যাম্বাসাডর। বিশ্বের বাঘা বাঘা রাষ্ট্রনায়ক তার নেতৃত্বগুণে মুগ্ধ।

গত ১২ বছরে শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। নির্বাচনে বারবার জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘকালীন নারী সরকারপ্রধানের মর্যাদায় ভূষিত হয়েছেন।

রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রজীবন থেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন শেখ হাসিনা। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে অন্য আর দশজন শিক্ষার্থীর মতো অংশ নিয়েছেন কিন্তু ছাত্রলীগের কোনো পদ-পদবি পাওয়ার চেষ্টা করেননি। তবে ইডেন কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজ ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচিত হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সেখান থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্র রাজনীতির সে সময়কার ঘটনা তুলে ধরে শেখ হাসিনা তার রচিত 'সাদাকালো' গ্রন্থে 'স্কুল জীবনের কিছু স্মৃতিকথা' প্রবন্ধে বলেছেন, 'আমি তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী, আয়ুববিরোধী আন্দোলনের সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট হলে আমাদের স্কুলে যাতে ধর্মঘট হয় সেই ব্যবস্থা নিতাম।'

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে যখন ঘাতকরা নৃশংসভাবে হত্যা করে তখন ঘটনাচক্রে স্বামীর সঙ্গে দেশের বাইরে ছিলেন শেখ হাসিনা। সঙ্গে ছিলেন ছোট বোন শেখ রেহানা। পিতা হারানোর পর আর তাকে দেশে ফিরতে দেয়নি তৎকালীন সরকার। ১৯৮১ সালের ১৭ মে পর্যন্ত দেশের বাইরে শরণার্থী জীবনযাপন করেছেন তিনি। মাতৃস্নেহ দিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে আগলে রেখেছিলেন দিল্লিতে। তার স্বামীকে একটি চাকরি জোগাড় করে দিয়েছিলেন। এদিকে বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তখন আওয়ামী লীগ অনেকটা ছত্রভঙ্গ। দলের ভেতর অন্তর্দলীয় কোন্দল তখন চরমে। অনেকে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের তখন ভয়ানক ক্রান্তিকাল। এমন পরিস্থিতিতে ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এর পর থেকে গত ৩৯ বছর নিজ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে দেশের অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনীতির মূল স্রোতধারার প্রধান নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। বিশ্বের সমস্যা ও সংকট নিরসনে ভূমিকার পাশাপাশি শোষিত-নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখায় তাকে এখন বিশ্বনেতার মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত চার মেয়াদে ক্ষমতাসীন। গণতন্ত্র এবং দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন-সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি সরকার পরিচালনায়ও ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ সালে তার সরকারের আমলে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি ও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি তার সরকারের বিশেষ সাফল্য হিসেবে বিবেচিত। তার নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারের টানা ১২ বছরে দেশে বিস্ময়কর উন্নতি হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি, একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শেষ করা, সংবিধান সংশোধনের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তি ও সমুদ্রবক্ষে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ব্লু ইকোনমির নতুন দিগন্ত উন্মোচন, বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট সফল উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে মহাকাশ জয়, সাবমেরিন যুগে বাংলাদেশের প্রবেশ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন, কর্ণফুলী টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নতুন নতুন উড়াল সেতু, মহাসড়কগুলো ফোর লেনে উন্নীত করা, প্রথমবারের মতো এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, মাথাপিছু আয় ১৯০৯ ডলারে উন্নীত, প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ১ শতাংশ, দারিদ্র্যের হার হ্রাস, বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২২ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে যাওয়া, ৯৪ শতাংশ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনা, যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন, সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত করা, বছরের প্রথম দিন প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে নতুন বই পৌঁছে দেওয়া, মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা ও স্বীকৃতি দান, মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, প্রতিটি জেলায় একটি সরকারি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ, নারীনীতি প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, ফোর-জি মোবাইল প্রযুক্তির ব্যবহার চালুসহ অসংখ্য ক্ষেত্রে কালোত্তীর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত ও মধ্যম আয়ের আধুনিক ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের গতিতে হঠাৎ ছন্দপতন হয় বৈশ্বিক মহামারি করোনায়। করোনা মোকাবিলায় গোটা বিশ্ব যেখানে হিমশিম খেয়েছে সেখানে বাংলাদেশ বেশ সফলতার সঙ্গেই এ ভাইরাসকে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের কারণেই। করোনাযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুতনয়া একজন অকুতোভয় সম্মুখযোদ্ধা। সদা সক্রিয়। সংকট মোকাবিলায় তিনি দিন-রাত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

করোনা নিয়ে সরকারের নানাবিধ প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যবিধি মানতে মানুষের স্বতঃস্ম্ফূর্ত আগ্রহের দরুন আমাদের দেশে করোনার লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হয়েছে; করোনার সংক্রমণ জ্যামিতিক হারেও বাড়তে পারেনি।

এ অঞ্চলে গণতন্ত্র, শান্তি ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং নারী শিক্ষার বিস্তার, শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস ও দারিদ্র্য বিমোচনের সংগ্রামে অসামান্য ভূমিকা রাখার স্বীকৃতি হিসেবে দেশি-বিদেশি বেশকিছু পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত হয়েছেন শেখ হাসিনা।

শেখ হাসিনা জাতির পিতার কন্যা, ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রধানমন্ত্রী অথচ ব্যক্তিজীবনে এখনও সেই সাদামাটা বাঙালিয়ানা। সম্প্রতি মহান জাতীয় সংসদের অধিবেশনেই তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ধারণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'সকালে ঘুম ভাঙার পর আগে জায়নামাজ খুঁজি। নামাজ পড়ি। তারপর নিজের চা নিজে বানিয়ে খাই। আমার ছোট বোন রেহানা আছে। যে আগে ওঠে সে চা বানায়। এখন আমার মেয়ে পুতুলও রয়েছে।'

'এখন তো করোনাকালে নামাজ পড়ে, চা খেয়ে বই-টই পড়ার থাকলে পড়ি। আর একটু হাঁটাহাঁটি করি। গণভবনে একটা লেক আছে। সেই লেকের পাশে বসে মাছ ধরি।'

'আমাদের বাবার শিক্ষা রিকশাওয়ালাকে আপনি করে বলতে হবে। ড্রাইভারকে সাহেব বলতে হবে। বাড়ির কাজের লোকজনকে হুকুম দেয়া যাবে না। আমরা সেই শিক্ষাই অর্জন করেছি। আমার বাসায় যারা কাজ করে তাদের কখনও হুকুম দিই না। বলি, আমাকে এটা করে দিতে পারবে? সেই শিক্ষাই জাতির পিতা আমাদের দিয়েছেন।'

বস্তুত, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার কোনো বিকল্প নেই। তিনি ৫৬ হাজার বর্গমাইলের বাঙালিকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে যেতে অনেকটা ঘটনাচক্রে আবির্ভূত হয়েছিলেন।

উপাচার্য, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×