ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

উচ্চশিক্ষা

কর্মসংস্থান ও ভর্তির সুযোগ অবারিত হোক

কর্মসংস্থান ও ভর্তির সুযোগ অবারিত হোক

ড. সাদেকা হালিম

প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ৩০ নভেম্বর ২০২০ | ০২:৪৭

করোনা দুর্যোগের মধ্যেও আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে সচল রাখার স্বার্থে প্রায় সবকিছুতেই আমরা 'নতুন স্বাভাবিকে' অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। তবে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে সরাসরি পাঠদান এখনও শুরু হয়নি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমরা দেখেছি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললেও অনেকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ফলে আবার বন্ধ রাখতে বাধ্য হয়েছে। উন্নত বিশ্বের যে ভৌত ও অনলাইন অবকাঠামো রয়েছে, তাতে সহজেই তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখতে পারত। তার পরও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখেনি। দেশেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার জন্য নানামুখী চাপ ছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী অবস্থার গুরুত্ব অনুধাবন করেই খোলার সিদ্ধান্ত দেননি। আমরা দেখেছি, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও খোলার ব্যাপারে প্রস্তুতির কথা বলে। তবে বাস্তবতার আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলার সিদ্ধান্ত সঠিক বলে আমি মনে করি। তাছাড়া আমরা দেখছি, অন্তত এক সপ্তাহ ধরে দেশে করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে। অনেক দেশে দ্বিতীয়বার লকডাউনের মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে করোনার ভ্যাকসিন আসার ইতিবাচক খবর সংবাদমাধ্যমে আসছে। তার পরও বিশ্বব্যাপী পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কত সময় লাগবে তা আমরা জানি না।

আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খুলতে পারলেও পরিবর্তিত পরিস্থিতির আলোকে এখন শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হবে। সে লক্ষ্যে ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়ে গেছে। উচ্চশিক্ষায় অনলাইনে কেবল পাঠদানই চালু হয়নি, একই সঙ্গে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পরীক্ষা গ্রহণসহ সব শিক্ষা কার্যক্রম অনলাইনে শুরু করছে। পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন পাঠদান কার্যক্রম চললেও বাস্তব কারণেই আমরা পরীক্ষা গ্রহণসহ অন্যান্য সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কারণ আমাদের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই গ্রামে বাস করছে। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা প্রয়োজনীর ডিভাইস, ইন্টারনেট সংযোগ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ সমস্যার কারণে নিয়মিত অনলাইন ক্লাস করতে পারছে না। অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কম্পিউটার নেই, কিছু ছাত্র অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে পাঠগ্রহণ করছে। শিক্ষার্থীদের একটা অংশ নানা সমস্যার কারণে অনলাইন ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিত হতে পারছে না। অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মাধ্যমে অ্যাসাইনমেন্ট তৈরি ও পরীক্ষা গ্রহণের বিষয়টি যথেষ্ট কঠিন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন পাঠদান নিয়ে যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা লক্ষ্য করছি, করোনাজনিত কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে প্রযুক্তি সংক্রান্ত এক ধরনের অসমতা তৈরি হয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে বলে সেখানকার শিক্ষার্থীরা টার্মিনাল ডিগ্রির ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকছে। যারা শেষবর্ষে কিংবা শেষ সেমিস্টারে ছিল, তারা স্নাতক শেষ করে ফেলছে। অথচ পরীক্ষা নেওয়া যায়নি বলে পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে যাচ্ছে। কেবল পরীক্ষা নিতে পারলেই তারা স্নাতক শেষ করে ফেলতে পারত, বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য চেষ্টা করতে পারত, চাকরির চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু পারছে না। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, দুটি বিসিএসের প্রজ্ঞাপন আসছে বলে সংবাদমাধ্যমে আমরা জেনেছি। এর মধ্যে ৪২তম বিসিএসটি বিশেষ এবং ৪৩তমটি সাধারণ হওয়ার কথা রয়েছে।

অন্তত টার্মিনাল ডিগ্রির শিক্ষার্থীরা যাতে আসন্ন বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারে সে জন্য জরুরি ভিত্তিতে তাদের পরীক্ষা শেষ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় পিএসসিতে ৪৩তম সাধারণ বিসিএসের চাহিদা পাঠিয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মোট এক হাজার ৮১৪টি পদের চাহিদা পাঠিয়েছে। আর ৪২তম বিশেষ বিসিএসে দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছে পিএসসি। আসন যা-ই হোক, বিসিএস অনেকেরই স্বপ্নের চাকরি। আমরা সম্প্রতি দেখেছি, বিসিএসে চার লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী আবেদন করে। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের টার্মিনাল ডিগ্রি অর্জন করেই প্রথমবারেই অনেকে বিসিএস পরীক্ষাগুলোতে উত্তীর্ণ হচ্ছে। স্বাভাবিক সময়ে আমাদের ওইসব শিক্ষার্থী এই বিসিএসে অংশগ্রহণ করতে পারত, তাদের সহপাঠী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি স্নাতক শেষ করে বিসিএসে অংশগ্রহণের সুযোগ পায়, তাহলে পাবলিক ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন পিছিয়ে থাকবে? যেভাবেই হোক তাদের পরীক্ষা নিয়ে বিসিএসসহ অন্যান্য চাকরিতে অংশগ্রহণ কিংবা উচ্চশিক্ষার পথ অবারিত করা প্রয়োজন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়ে আসি। এ বছর করোনার কারণে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা নেওয়া যায়নি বলে এসএসসি ও জেএসসির ফলের ভিত্তিতে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল নির্ধারণের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরেই ফল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এরপর আসবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির বিষয়। আমরা দেখেছি, স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট ছাড়া অন্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা হবে। শিক্ষামন্ত্রী স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে একত্রে পরীক্ষা নেওয়ার কথা ভেবে দেখতে বলেছেন। তবে এই পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বতন্ত্র বিবেচনায় নিজস্ব বক্তব্য রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগভিত্তিক পৃথক পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেছে। এর মধ্যে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে 'ঘ' ও 'চ' ইউনিটের (চারুকলা) জন্য আলাদা করে ভর্তি পরীক্ষা বাদ দেওয়ার প্রস্তাব ও আলোচনা আসলে চারুকলা অনুষদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার্থে 'চ' ইউনিট রেখে 'ঘ' ইউনিটের বিষয়ে পর্যালোচনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ৩ ইউনিট বজায় রেখে 'ঘ' ইউনিট নিয়ে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। 'ঘ' ইউনিটের মাধ্যমে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্যের শিক্ষার্থীরা তাদের নিজস্ব ইউনিটের (ক, খ ও গ) পাশাপাশি প্রায় বিভাগ পরিবর্তন করে অন্য বিভাগে ভর্তি হতে পারে। বাস্তব অর্থে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এই ইউনিটের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায়। প্রায় চার দশক ধরে 'ঘ' ইউনিট পৃথক পরীক্ষা নিচ্ছে। ভর্তি পরীক্ষার এমসিকিউ অংশে ক, খ, গ ও ঘ ইউনিটের বাংলা ও ইংরেজি অংশে মিল রয়েছে। কিন্তু 'ঘ' ইউনিটের বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির প্রশ্ন সামাজিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় প্রেক্ষিতের আলোকে করা হয়। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে এমসিকিউর পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়েছে, যা অন্য যে কোনো ইউনিট এমনকি মানবিকের জন্য নির্ধারিত 'খ' ইউনিট থেকে একদম কন্টেন্ট ও প্যাডাগজির দিক থেকে একদম স্বতন্ত্র। এমনকি আমরা দেখছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিটগুলোর মধ্যে 'ঘ' ইউনিটেই সবচেয়ে বেশি আবেদন পড়ে। উচ্চ মাধ্যমিকের সিলেবাসে বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের জন্য বাংলা ও ইংরেজি সবাইকে পড়তে হয়। কিন্তু পৌরনীতি, ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান সরাসরি সামাজিক বিজ্ঞানের অধীত বিষয়। সুতরাং ভর্তি পরীক্ষার ইউনিট বাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে পর্যালোচনা বাঞ্ছনীয়। হঠাৎ করে সিদ্ধান্ত নিলে শিক্ষার্থীরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয়বার বা পরবর্তী বছরে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল। বছর পাঁচেক আগে সেই সুযোগ বন্ধ হয়েছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ তাত্ত্বিকভাবে ৫০ শতাংশ কমে গেছে।

যারা নিজেদের ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় (ক, খ ও গ) ভালো করতে পারে না তাদের জন্য বিকল্প হিসেবে 'ঘ' ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েও ভর্তির সুযোগ থাকে। বর্তমান ভর্তি প্রক্রিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ঘ' ইউনিটের মাধ্যমে তারা একই বছরে দু'বার দুটি ভিন্ন দিন ও সময়ে (ক, খ, গ ও ঘ) ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ পায়। 'ঘ' ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ হলে বিদ্যমান পদ্ধতিতে টিকে থাকা ভর্তির সম্ভাবনা আরও ৫০ শতাংশ কমে যাবে। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কথা বলা হলেও প্রকৃত প্রস্তাবে শিক্ষার্থীরা বিভাগেই ভর্তি হয়। বিভাগগুলোর সমগোত্রীয়তা বিবেচনা করে একটি অনুষদের ছাতার নিচে বিভাগগুলোকে রাখা হয়। সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মধ্যে ১৬টি বিভাগ আছে। 'ঘ' ইউনিটের মাধ্যমে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদেও অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমাজবিজ্ঞান, লোকপ্রশাসন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, নৃবিজ্ঞান, জনসংখ্যা বিজ্ঞান, উইমেন ও জেন্ডার অধ্যয়ন, উন্নয়ন অধ্যয়ন, টেলিভিশন ফিল্ম ও ফটোগ্রাফি, যোগাযোগ বৈকল্য ও মুদ্রণ এবং প্রকাশনার মতো বিভাগে আলাদা পরীক্ষার মাধ্যমে আলাদাভাবে ভর্তির সুযোগ তৈরি হয়। এই বিভাগগুলোর কারিকুলাম সরাসরি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বিভাগগুলো বৈচিত্র্য, বহুত্ববাদ ও ইন্টারডিসিপ্লিনারি একাডেমিক চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করে। সামাজিক অসমতা, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক বৈষম্য, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রশাসনসহ সবকিছুকে নিয়ে এই অনুষদ কাজ করছে এবং সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করছে। বাংলাদেশে জনপরিসরে এই অনুষদ স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর হিসেবে গড়ে উঠেছে। এসব বিষয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধানেও শিক্ষায় সুযোগ বৃদ্ধির কথা বলা আছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশে আমরা যেখানে শিক্ষার সুযোগ ও জ্ঞানের সম্প্রসারণ দেখছি, সেখানে 'ঘ' ইউনিট ভর্তি পরীক্ষা বন্ধ করে শিক্ষার সুযোগ ও জ্ঞানবৈচিত্র্য সংকোচনের পথে কেন হাঁটছি? আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্নিষ্টরা বিষয়টি নিয়ে ভাববেন। একই সঙ্গে করোনার মধ্যেও আমাদের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে হবে। করোনার প্রভাবে উচ্চশিক্ষার টার্মিনাল ডিগ্রি অর্জনের শেষ পর্যায়ে যারা আছে তাদের চাকরির বাজারে অভিগম্য নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের এখনই সময়।

ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও পড়ুন

×