শ্রদ্ধাঞ্জলি
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে একজীবন

আবদুল হান্নান খান
আনিসুর রহমান
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:২৬
একবার একটা আইনি জটিলতায় নাস্তানাবুদ অবস্থা আমার। ঝামেলাটার শুরু ২০০৭ সালে ফখরুদ্দিন-মইনুদ্দিন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জামানায়। টাঙ্গাইলের মধুপুর বাসস্ট্যান্ডে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ করতে চেয়েছিলাম। মধুপুর থেকে এগিয়ে এসেছিল নাগরিক পরিষদ। এই উদ্যোগের সঙ্গে মধুপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা মাসুদ পরভেজ এবং নাগরিক পরিষদের সভাপতি ফারুক হোসেনসহ আমার স্কুল সহপাঠী বন্ধুদের বিশেষ করে মোশাররফ হোসেন বাবলু, কামাল হোসেনের বড় রকম ভূমিকা ছিল। আর এটাই কাল হলো।
আমাদের প্রথম জমায়েতকে ১৪৪ ধারা জারি করে পণ্ড করে দেওয়া হলো। এর পেছনের ইন্ধনদাতা ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতাকর্মীরা আর তাদের ইন্ধনপুষ্ট আমলারা। তাদের ষড়যন্ত্রে মধুপুরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হলো। আমি ঝামেলায় পড়ে গেলাম। সে লম্বা গল্প। ঢাকায় থাকি। এলাকায় যেতে পারি না। এর মাঝে দেশের ভেতরে-বাইরে কর্মসূত্রে দৌড়াদৌড়ি। ঢাকা পর্যন্ত যাই, সেমি ফেরারির মতো দিন পার করি। মধুপুরে যাওয়া হয় না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে আমার সহপাঠী মোনালিসা খান ঘটনাটি জানার পর একদিন নিজে থেকে বলল, চলো তোমাকে আমার কাকার কাছে নিয়ে যাই।
তার কাকা মানে আমারও কাকা। কাকার অফিসে গেলাম। যিনি পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা, দেশে-বিদেশে যার পরিচিতি আর খ্যাতি। নাম আবদুল হান্নান খান। তার অফিস কক্ষে ঢুকে দেখি যেন কোনো শিক্ষকের কক্ষ। এত সুন্দর রুচিসম্মত ছিমছাম একটা ঘর। নেই আসবাবের বাড়াবাড়ি। নানা রকমের বই আর পত্রিকা সাময়িকীর সমাহার। জীবনের এই প্রথম দেখা ও দীর্ঘ আলাপচারিতা। আগে তেমন কিছু জানতাম না ওনার সম্পর্কে।
গল্পে গল্পে জেনে গেলাম উনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিলেন। জড়িত ছিলেন ছাত্র রাজনীতিতে, কৈশোরে ১৯৬০-এর দশকের শুরুতে। ডাকসুতে সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৬৪ সালে। কর্মজীবনের শুরুতে দেশের জামালপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৭১-এ ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭৩-এ কর্মকমিশনে পরীক্ষা দিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা হয়েছেন। ওনার গল্প উনি বলে যাচ্ছেন দিলখোলা প্রাণবন্ত হাসিমুখে। আমরাও মুগ্ধ হয়ে শুনছি। শেষটায় উনি বললেন, এবার বল, তোমরা কেন এসেছিলে? সহপাঠী আমার সমস্যাটা উনাকে জানাল। সঙ্গে সঙ্গে উনি দাঁড়িয়ে গিয়ে সংশ্নিষ্ট জায়গায় ফোন করে বলে দিলেন, সঙ্গত এবং আইনসম্মত একটা সমাধানের পথও বাতলে দিলেন সংশ্নিষ্ট সূত্রকে। সমূহ বিপদ থেকে বেঁচে গেলাম।
বছরখানেক পরে দ্বিতীয়বার আবারও গেলাম হান্নান কাকার অফিসে। এবারেও দীর্ঘ আলাপ। ওনার সঙ্গে আলাপে আমার মনে হয়েছে অন্যসব কাজের ঝক্কির মাঝে থেকে তার সন্তানের প্রজন্মের আমাদের কাছে পেয়ে যেন আত্মীয়মাখা স্নেহ ও অনুরাগ উজাড় করে ঢেলে দিচ্ছেন। উপলব্ধি আর পর্যবেক্ষণসম্পন্ন একজন মানুষ। আলাপের একপর্যায়ে জানালেন, আনিস তুমি একটা বুদ্ধি দিতে পার? একটা সমস্যায় পড়েছি।
ব্রাজিল থেকে সংগ্রহ করা যুদ্ধাপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়ার কিছু দলিল-দস্তাবেজের ছোট কয়েক পাতার একটি প্রকাশনার স্প্যানিশ থেকে ইংরেজি অথবা বাংলায় অনুবাদ করা দরকার। আমি বললাম কাকা, চিন্তা কইরেন না। কাগজগুলোর অনুলিপি আমাকে দিন। আমার স্প্যানিশ ভাষাভাষী বন্ধুদের দিয়ে কাজটা আমি করিয়ে দেব।
এরপর পারিবারিক একটা বিপদের কারণে আমার অনুবাদের উদ্যোগ নিতে বিলম্ব হচ্ছিল। আমিও কাকার সামনে পড়ি না, সংকোচে ফোন করি না। একদিন হঠাৎ মোনালিসা ফোন করে বলে, আমি কাকার অফিসে, ধরো কাকার সঙ্গে কথা বল। এটাই ছিল কাকার সঙ্গে আমার শেষ আলাপ।
হান্নান কাকা এলাকায় অসম্ভব রকম জনপ্রিয়। শেখ হাসিনা উনাকে অসম্ভব রকম গুরুত্ব দিতেন, বিশ্বাস করতেন। 'হান্নান ভাই' বলে সম্বোধন করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্তে অন্য কারও ওপর ভরসা করতে চাইছিলেন না। মামলা তিনটা হচ্ছে- বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, জেল হত্যা মামলা এবং যুদ্ধাপরাধ মামলা।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত বিতর্কমুক্তভাবে সম্পন্ন করার কারণে তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জীবনের পুরোটা সময় কানায় কানায় দেশ, দেশের মানুষের কল্যাণে নিবেদিত করে গেলেন।
আবদুল হান্নান খান ছিলেন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক। পুলিশের আইজি বীর মুক্তিযোদ্ধা, নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলার আবদুল হান্নান খান। সহপাঠী মোনালিসার বাবা ভাষাসংগ্রামী আবদুল ওয়াদুদ খান অকালে চলে গেছেন। এই হান্নান কাকা ছিলেন মোনালিসাদের জন্য বাবার শূন্যস্থান আলোয় ভরে তোলা একজন পিতৃসম চাচা। নিজের ছেলেমেয়ে এবং ভাতিজা-ভাতিজিদের সমান চোখে দেখার সমান ভরসার হাত প্রসারিত করার মতো বিরল দৃঢ়তা ও উদারতাসম্পন্ন মানুষদের একজন ছিলেন তিনি।
কেবল আমি নই, নির্বাচনী এলাকা এবং গোটা নেত্রকোনার মানুষ উনাকে আপন আত্মীয়ের মতো ভালবাসে, সম্মান করে, কেবল পুলিশের একজন আইজি হিসেবে নয়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, একজন সৎ, নিরহংকার মানবিক গুণসম্পন্ন বিরল একজন মানুষ হিসেবে। তার চলে যাওয়া মানে পূর্বধলা আর নেত্রকোনার আকাশে যেমন, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আকাশ থেকে একটি আলোকিত নক্ষত্রের পতন।
শহীদ মিনারে একবার এক আলোচনা সভায় তিনি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ১৯৭১-এর মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় শহুরে ও প্যান্ট-কোট পরা শিক্ষিত সনদধারীরা খুব একটা সাক্ষ্য দিতে আসে না। সাক্ষ্য দিতে আসে গ্রামের নিরীহ নিগৃহীত লুঙ্গিপরা মানুষগুলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তারাই ধারণ করেন। হান্নান কাকা নিজেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা স্মরণ করতেন হৃদয় দিয়ে। সারাজীবন এই মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কাব্য করে গেলেন।
সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা পরিষদের সদস্য
- বিষয় :
- শ্রদ্ধাঞ্জলি
- আনিসুর রহমান