সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সবার অধিকার

ফেনী জেলা কারাগারের সামনে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয়- ছবি সংগৃহীত
ব্রিগেডিয়ার (অব.) আব্দুল মালিক, অধ্যাপক ডা. এ কে আজাদ খান, অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ ও অধ্যাপক ডা. হাবিবে মিল্লাত
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:১১
মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে চিকিৎসাসেবা প্রাপ্তি বা সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা। ধনী-গরিব, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব ধরনের রোগের চিকিৎসাসেবা পাওয়া সবার অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। বিপুল জনসংখ্যার এই দেশে স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বরাদ্দ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল হওয়ায়, চিকিৎসা ব্যয়ের বড় অংশই রোগীকে বহন করতে হয়। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টের হিসাব অনুযায়ী, যেকোনো পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য ৬৭ শতাংশ ব্যয় ব্যবহারকারীর নিজেরই বহন করতে হয়। এই চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতি বছর ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে রোগের ধরনে পরিবর্তন এসেছে। কলেরা, হাম, বসন্তের মতো সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমে গেছে। বিপরীতে প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে হৃদরোগ, ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি রোগের মতো অসংক্রামক রোগগুলো। দীর্ঘমেয়াদি এসব রোগের চিকিৎসা যথেষ্ট ব্যয়বহুল। ফলে এসব রোগে আক্রান্ত হলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত রোগীরা অনেকক্ষেত্রে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। অনেককে সহায়-সম্পত্তি বিক্রি করে চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হয়। আবার অনেকে ব্যয় মেটাতে না পারায় চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হয়। এসব সমস্যার সমাধান করতে এবং সবার জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা।
দেশের সব মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালগুলোতে সব ধরনের রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেজন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক চিকিৎসক-নার্সসহ সেবাকর্মীর ব্যবস্থা করতে হবে। ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রীর দামও নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, যাতে করে অসহায়-দরিদ্র জনগোষ্ঠী চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়। প্রয়োজনে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত হতদরিদ্র শ্রেণির জনগোষ্ঠীর জন্য যেকোনো রোগের বিনামূল্যে মানসম্পন্ন চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া জটিল রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য উন্নত বিশ্বের মতো সবাইকে স্বাস্থ্য বীমার আওতায় আনাও অনেক জরুরি। তবে সবার জন্য স্বাস্থ্যবীমা চালু করাটা অনেক দীর্ঘমেয়াদি একটি প্রক্রিয়া। এজন্য নতুন আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, প্রশাসনিক তদারকিসহ বিভিন্ন স্তরে কাজ করতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। তবে এটা বাস্তবায়ন করা হলে হঠাৎ করে কারও হার্ট অ্যাটাক বা এ ধরনের জটিলতা তৈরি হলে জরুরি চিকিৎসার ব্যয় নিয়ে তাদের চিন্তায় থাকতে হবে না। বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান অসংক্রামক বিভিন্ন রোগ- হৃদরোগ, কিডনি, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বহু মানুষ মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত, নিম্নবিত্ত আরও গরিব হয়ে পড়ছে। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন করতে হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই। দেশের সব মানুষকে এ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হবে। তাছাড়া স্বল্প আয়ের মানুষদের এসব রোগের চিকিৎসার জন্য স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বা এককালীন সাহায্য দেওয়ার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। এসব রোগের চিকিৎসার পাশাপাশি রোগগুলো প্রতিরোধেও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করলে দেখা যাবে, রোগের চিকিৎসা ব্যবস্থার চেয়ে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হলে তা রাষ্ট্রের জন্য বেশি লাভজনক হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন ও নীতিমালা, যেমন- তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পরিবর্তন, প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে লবণ ও ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি নীতিমালা প্রণয়ন জরুরি। সেইসঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, কায়িক পরিশ্রমের বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরির দিকেও নজর দিতে হবে। সাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও যথাযথ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, সংসদ সদস্যবৃন্দসহ নীতিনির্ধারকদের নজর দিতে হবে। যৌথ প্রচেষ্টায় সব শ্রেণির মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব।
লেখকবৃন্দ যথাক্রমে সভাপতি, ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ; সভাপতি, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি; সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ এবং সংসদ সদস্য ও চেয়ারম্যান, স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশন
- বিষয় :
- স্বাস্থ্য সুরক্ষা
- সর্বজনীন
- অধিকার