রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি
'সুরক্ষিত' পথ অরক্ষিতই থাকবে?

সম্পাদকীয়
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৪:৫১
সারাবিশ্বে ট্রেনকে শুধু সাশ্রয়ী ও আরামদায়ক গণপরিবহনই ভাবা হয় না, রেলে ভ্রমণ অপেক্ষাকৃত নিরাপদও বটে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা এ ক্ষেত্রে যেন বিপরীত। প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ অরক্ষিত রেলক্রসিং। সারাদেশে রেলপথে প্রায় ২ হাজার ৫৪০টি রেলক্রসিং আছে। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশেরই গেটম্যান নেই। আবার যেগুলোতে আছে, সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও যে কতটা নাজুক এরই ফের মর্মন্তুদ সাক্ষ্য মিলেছে শনিবার জয়পুরহাট সদরে ট্রেনের ধাক্কায় হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে। রোববার সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, জয়পুরহাট সদর উপজেলার পুরানপৈল রেলক্রসিংয়ে শনিবার সকালে ওই দুর্ঘটনায় অন্তত ১২ জনের প্রাণহানি ঘটে। রেলক্রসিংয়ে দায়িত্বরত গেটম্যান ঘুমিয়ে থাকায় বিনা বাধায় একটি যাত্রীবাহী বাস রেললাইনে উঠে গেলে ট্রেনটির ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায়। আমাদের স্মরণে আছে, গত ৭ নভেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈর ও ১১ অক্টোবর ফেনীতে দুটি রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা ঘটে।
সংবাদমাধ্যমে জানা গিয়েছিল, ওই দুই স্থানেও গেটম্যান ঘুমিয়ে ছিল। প্রতিবন্ধকতাহীন ওই ক্রসিং দিয়ে বাস রাস্তা অতিক্রম করছিল। আমরা জানি, রেলপথে অনুমোদিত ও অননুমোদিত দুই শ্রেণির ক্রসিং আছে। কিন্তু জয়পুরহাটের পুরানপৈল ক্রসিংটি অনুমোদিত। কিন্তু এরকম ক্রসিংয়ে নিরাপত্তার জন্য রেলওয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোক থাকা সত্ত্বেও মর্মন্তুদতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে।
জয়পুরহাটের ঘটনাটি ফের প্রশ্ন দাঁড় করিয়েছে- আর কতদিন রেল ক্রসিংগুলো মৃত্যুফাঁদ হয়ে থাকবে? আমাদের সড়কপথের নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। বাড়তি উদ্বেগের বিষয়, রেলপথও অনিরাপদ হয়ে উঠেছে। একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে কিন্তু এরপরও রেল কর্তৃপক্ষের নিদ্রা ভঙ্গ হচ্ছে না! অনেক রেলক্রসিংয়ে নেই প্রতিবন্ধক গেট। অনেক ক্রসিংয়ে অস্থায়ী গেটম্যান থাকলেও তাদের দায়বদ্ধহীনতার কথাও নতুন করে বলার কিছু নেই। দৈনিক মজুরি কিংবা প্রকল্পের আওতায় কাগজপত্রে কিছু ক্রসিংয়ে গেটম্যান দায়িত্ব পালন করছেন তাদের মতো করে। কিছু পাহারাদার ছাড়া সিংহভাগেরই নেই প্রশিক্ষণ এবং অভিজ্ঞতাও। ফলে তাদের দায়িত্ব অবহেলায় এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেই চলেছে। জয়পুরহাটের ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ও রেলওয়ে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে- অতীতে প্রতিটি দুর্ঘটনার পরই এমন তদন্ত কমিটি হয়েছে, প্রতিবেদনও জমা পড়েছে কিন্তু প্রতিকার চিত্র বিরল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দায়ী করা হয়েছে গেটম্যানকে।
ঊর্ধ্বতনরা থেকে যান দৃষ্টির বাইরে। রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি কমাতে দীর্ঘদিন ধরেই রেল কর্তৃপক্ষ ও সড়ক নির্মাণকারী সংস্থার মধ্যে চিঠি চালাচালি চললেও অরক্ষিত রেলক্রসিং সুরক্ষিত হচ্ছে না। অনেকবার আলোচনা হলেও ক্রসিংগুলোতে ডিজিটাল ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হচ্ছে না- এও বিস্ময়কর প্রশ্ন। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ের বাইরেই থেকে যাবে রেলওয়ে? দুর্ঘটনা ও হতাহতের দায় রেল কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না। আমাদের প্রশ্ন- আর কত মর্মস্পর্শী ঘটনা ঘটলে রেল কর্তৃপক্ষের টনক নড়বে? আমরা আশা করব, অতীতের মতো তদন্ত কমিটি গঠন আর প্রতিবেদন দাখিলের মধ্য দিয়েই সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল মহলগুলোর দায় যেন শেষ হয়ে যাবে না।
একই সঙ্গে যানবাহনগুলোর চালককে রেলক্রসিং অতিক্রম করার সময় সতর্ক ও সজাগ থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, তাদেরও দায় কম নয়। যাদের প্রাণহানি হয়েছে কোনো তদন্ত কিংবা ক্ষতিপূরণ তাদের ফিরিয়ে আনতে পারবে না। তারপরও নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ এবং আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে। দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনলে এ ধরনের অবহেলাজনিত দুর্ঘটনা হ্রাস পাবে। আমরা মেট্রোরেল যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। এ অবস্থায় রেলপথে ঠুনকো নিরাপত্তা ব্যবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
- বিষয় :
- রেলক্রসিংয়ে প্রাণহানি
- রেলক্রসিং
- প্রাণহানি