ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

স্মরণ

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য শ্রমিক নেতা আবু সুফিয়ান

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য শ্রমিক নেতা আবু সুফিয়ান

আবু সুফিয়ান (১৯৪৩-১৯৭২)

বেগম মন্নুজান সুফিয়ান

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ১২:০০ | আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০২০ | ১৫:১২

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আদর্শের অকুতোভয় সৈনিক, শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান বীরপ্রতীককে খুব স্নেহ করতেন। একদিন বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকে বললেন, তোকে জার্মানির রাষ্টদূতের দায়িত্ব দিতে চাই, তখন অধ্যাপক সুফিয়ান সবিনয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু আমাকে রাষ্টদূত করবেন কিন্তু আমার ৪০ হাজার শ্রমিক তো আর রাষ্ট্রদূত হতে পারবে না। আমার ৪০ হাজার শ্রমিককে রেখে আমি কোথাও যেতে চাই না। শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আত্মার সঙ্গে ছিল তার নিবিড় সম্পর্ক। শ্রমিকদের কতটা ভালোবাসলে, শ্রমিকদের প্রতি কতটা হৃদ্যতা থাকলে জাতির পিতার কাছ থেকে পাওয়া প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেওয়া যায় তার উদাহরণ শ্রমিক নেতা আবু সুফিয়ান। এর কিছুদিন পর অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কয়েকজন শ্রমিক নেতাকে ১৯৭২ সালে জার্মানিতে এক সম্মেলনে পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। দেশে ফেরার পর ১২ দিনের মাথায় ২৮ ডিসেম্বর খুলনা-যশোর রোডের মহসিন মোড়ের ইসলাম ম্যানশনে কেন্দ্রীয় শ্রমিক লীগের আঞ্চলিক অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় রাত ১০টার দিকে রাস্তায় দুর্বৃত্তদের ব্রাশফায়ারে তিনি শহীদ হন। মাত্র ২৯ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে শ্রমিক সমাজের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করা শ্রমিক নেতা শহীদ অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের আজ ৪৮তম শাহাদাতবার্ষিকী। তার স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

আবু সুফিয়ানের নামের সঙ্গে মিশে আছে দেশপ্রেমের দীপ্তমান আভা। শ্রমজীবী মানুষের প্রেরণার বাতিঘর, বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবক। জীবনের স্বল্পতম সময়ে মহসিন কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানে ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে শিক্ষকতা করেন। একজন অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ানের এ দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করার অসীম স্বপ্ন ছিল। সবার সব স্বপ্ন সবসময় তো আর পূরণ হয় না। বিপথগামী কিছু মানুষ থাকে, যারা সমাজের মানুষের মঙ্গল চায় না।

আমার ব্যক্তি জীবনের চরমতম বেদনাবিধুর দিনে বঙ্গবন্ধুকেও খুব বেশি মনে পড়ছে। আবু সুফিয়ান দুর্বৃত্তদের দ্বারা আক্রান্ত- এই খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন খুলনার পুলিশ সুপার বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহবুব উদ্দিন আহমদকে ফোন করে আবু সুফিয়ানের শেষ খবর নেন। বলেন, 'সুফিয়ানের দেহে যদি এতটুকুও প্রাণ থাকে তাহলে তুমি সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ কর।' বঙ্গবন্ধু এই দুঃসংবাদে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট। সেদিন অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের স্মৃতি স্মরণ করে সুফিয়ানের সহধর্মিণী হিসেবে আমার সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছিলেন। সেদিন বঙ্গবন্ধু খুলনায় অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের নামে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নামকরণে আমাদের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব রূপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার মাত্র তিন দিনের মাথায় ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে জাতির পিতা সপরিবারে শাহাদাতবরণ করলে সেই আকাঙ্ক্ষা অঙ্কুরেই শেষ হয়ে যায়।

অধ্যাপক আবু সুফিয়ানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্নেহমাখা মধুর সম্পর্ক ছিল। কোঁকড়ানো লম্বা চুলের কারণে বঙ্গবন্ধু তার আদর্শের অকুতোভয় এই সৈনিককে আদর করে 'মোস্তান' বলে ডাকতেন। সম্ভবত ১৯৭০ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সম্মেলনের দিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আমাকে এবং অধ্যাপক আবু সুফিয়ানকে দেখে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি তোদের দেখে খুশি, কারণ তোরা এক পরিবারে দু'জনই নেতা। অধ্যাপক সুফিয়ান প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা আর আমি তখন খুলনা বয়রা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি। অধ্যাপক সুফিয়ানের মৃত্যুর পর বঙ্গবন্ধু যে তিন বছর বেঁচে ছিলেন সবসময় আমাদের পরিবারের খোঁজ রেখেছেন। পিতার দেখানো পথ অনুসরণ করে তার সুযোগ্য দুই কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা একান্ত আপনজনের মতো আমাকে ও আমার পরিবারকে আগলে রেখেছেন। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কাছে আমি চির ঋণী।

আবু সুফিয়ান চাঁপাইনবাগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলার আড্ডা গ্রামে এক সল্ফ্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৩ সালের ১ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি শিক্ষাজীবনে বিএল কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রনেতা ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে ১৯৬৬-৬৭ সালে শাহ মখদুম হলের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিলেন। পরে শ্রমিক অধ্যুষিত খুলনা অঞ্চলের শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় শ্রমিক রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন। সুফিয়ান বঙ্গবন্ধুর ডাকে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যুদ্ধকালীন তিনি পলতা ইয়ুথ ক্যাম্পের 'ক্যাম্প ইনচার্জ' ছিলেন। যুদ্ধের সময় আসাম, ত্রিপুরা এবং মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে যেসব বাঙালি ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন তাদের কাছে পাকিস্তানি সেনা ও তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের অত্যাচার, নির্যাতনের কথা শুনে কথিকা তৈরি করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পাঠ করেন। সুফিয়ান কখনও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। রাজনৈতিক জীবনে বাংলাদেশ জাতীয় শ্রমিক লীগের সহসভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের খুলনা জেলা শ্রম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার যোগ্য নেতৃত্বে খালিশপুর, দৌলতপুর, আটরা শিল্প এলাকায় ন্যায্য দাবি আদায়ে শ্রমিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন। সারাদেশের শ্রমজীবী মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্মরণ করে।

মাত্র ছয় বছরের বিবাহিত জীবনে ২১ বছর বয়সে আমি মহান এই মানুষটিকে হারিয়ে দু'চোখে অন্ধকার দেখি। জীবন তো আর থেমে থাকার নয়, অল্প বয়সে স্বামী হারিয়ে মাত্র দুই বছর বয়সী একমাত্র মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে গভীর শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে আমি জাতির পিতার আদর্শ হৃদয়ে ধারণ করে শ্রমিকদের পাশে দাঁড়াই। এ দেশের লাখো কোটি শ্রমজীবী-মেহনতি অসহায় মানুষের ভালোবাসা এবং আমাদের সবার আস্থার স্থল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আশীর্বাদ নিয়ে আজ আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে জনসেবার সুযোগ পেয়েছি। বলতে দ্বিধা নেই, আমার আজকের অবস্থানের মূল প্রেরণা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক শ্রমিক নেতা অধ্যাপক সুফিয়ান বেঁচে রয়েছেন তার কর্ম ও আদর্শের মাঝে।

প্রতিমন্ত্রী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়

আরও পড়ুন

×