করোনা পরিস্থিতি
স্টু্কল খুললে সব পড়ূয়াকে ফেরানো চাই

অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রকাশ: ০৯ আগস্ট ২০২১ | ১২:০০
স্কুল খুললে ভাবা দরকার- গত দেড় বছর স্টু্কল বন্ধ থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, কী কী উপায়ে তা সামাল দেওয়া যায়। এ চ্যালেঞ্জ জয় করতে গেলে কয়েকটি কাজ করা যেতে পারে। প্রথম কাজ হলো, সিলেবাস শেষ করার ওপর জোর না দিয়ে শিশুদের লিখতে-পড়তে, অঙ্ক কষতে পারার দক্ষতা তৈরি করা। যত দূর বোঝা যাচ্ছে, খুব বেশিসংখ্যক শিশু অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। বাড়িতে পাঠানো প্রশ্নের উত্তর লিখেও তারা সম্ভবত খুব বেশি কিছু শেখেনি। অনেকে লেখাপড়া থেকে একেবারেই বিচ্ছিল্প। যেটুকু শিখেছিল, তা-ও ভুলে গেছে। তাই আগেই শিক্ষকদের দেখতে হবে, ছাত্রছাত্রীরা কে কতটুকু লিখতে-পড়তে পারছে। তারা এখন কোন পর্যায়ে রয়েছে, তা বুঝে নিয়ে তাদের এমনভাবে পড়াতে হবে, যাতে তারা নিজের শ্রেণির উপযুক্ত লেখা ও পড়ার ক্ষমতা আয়ত্ত করতে পারে।
এ ব্যাপারে 'প্রথম' স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির শিক্ষা পদ্ধতি বেশ কাজে লাগে, তা প্রমাণিত। এ সংস্থার কর্মীরা প্রথমেই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে পড়ূয়ার ক্ষমতার ধাপ নির্ধারণ করে নেয় (যেমন- শিশুটি অক্ষর চেনে না। অথবা অক্ষর চেনে কিন্তু শব্দ পড়তে পারে না, কিংবা শব্দ পড়তে পারে কিন্তু বাক্য পারে না)। তারপর একই ধাপের ছেলেমেয়েদের একটি দলে নিয়ে এসে তাদের উপযোগী পাঠ পড়ায়। ওই শিশুরা বয়স অনুসারে স্টু্কলের নানা শ্রেণির পড়ূয়া হতে পারে, কিন্তু লেখাপড়ার পাঠ নেয় একসঙ্গে। যে নিজের ধাপের দক্ষতা আয়ত্ত করে ফেলে, সে চলে যায় পরবর্তী দলে। দেখা গেছে, এমন করে কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রায় শ্রেণি-উপযোগী দক্ষতায় পৌঁছে যায় ছেলেমেয়েরা। দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে বহু পড়ূয়া সম্ভবত শ্রেণি-উপযোগী লিখতে-পড়তে পারার ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই এখন এ পদ্ধতি বিশেষ কাজে লাগতে পারে। তৃতীয় শ্রেণির পড়ূয়াকে শুরু করতে হতে পারে প্রথম শ্রেণির পাঠ থেকে, পঞ্চম শ্রেণির পড়ূয়াকে দ্বিতীয় থেকে। শ্রেণির সিলেবাস ধরে পড়াতে গেলে তার সুযোগ মিলবে না। প্রতিটি ছেলেমেয়ে লিখতে-পড়তে, অঙ্ক করতে পারার ক্ষমতা রপ্ত যাতে করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই স্কুল শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার। যে কোনো সময়েই এটা সত্য, কিন্তু এখন এটা না করলেই নয়।
দ্বিতীয় কাজ হলো, প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এ বিষয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার একটা স্লোগান তৈরি করতে পারে, যা শতভাগ শিশুকে স্টু্কলে ফেরানোর ডাক দেবে। একটি শিশুও যেন বাড়ি, ফসলের ক্ষেত, দোকান-বাজার, কল-কারখানায় থেকে না যায়। বিশেষত স্কুলপড়ূয়া মেয়েদের বাড়ির কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে স্টু্কলে। কাজটা সহজ হবে না, কারণ বহু পরিবার অতিমারির জেরে রোজগার হারিয়েছে। কাল যারা ছিল স্টু্কলপড়ূয়া, আজ তাদের কেউ মায়ের সঙ্গে লোকের বাড়িতে কাজে যাচ্ছে, কেউ বাবার দোকান সামলাচ্ছে, কেউ বাড়ি থেকে দূরে চলে গেছে রোজগারের আশায়। কিন্তু এই শিশুদের হারিয়ে ফেলা চলবে না। অতিমারির কঠিন সময়ে কিছু শিশু তো স্কুলছুট হবেই- এমন মনোভাব দেখা দিলে তা হবে শিশুর জন্য ভয়ংকর, এমনকি দেশের জন্যও। প্রত্যেক শিশুকে ফিরতে হবে স্কুলে- এই অঙ্গীকার হতে হবে শর্তহীন, সংশয়হীন। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হলে দরিদ্র শিশুকে স্টু্কলে ফেরাতেই হবে; কাজে পাঠানো চলবে না।
দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সব শিশুকে যেমন ফিরিয়ে আনা চাই, তেমনি সব শিশুর নিয়মিত স্টু্কলে আসাও নিশ্চিত করা চাই। মুশকিল হলো, স্টু্কলের রেজিস্টার দেখে শিশুদের প্রকৃত উপস্থিতি সব সময় বোঝা যায় না। স্টু্কলে সব পড়ূয়াকে নিয়ে আসা এবং তাদের নিয়মিত পঠন-পাঠনের অংশীদার করে তোলার জন্য দরকার স্টু্কলগুলোর ওপর নজরদারির একটা ব্যবস্থা। এখন গ্রাম-শহরের প্রতিটি স্কুলে নজরদারি চাই। তাই অন্যান্য সমাজ-সংগঠনকেও জড়িয়ে নিতে হবে। যেসব এনজিও শিক্ষাসহ সমাজকল্যাণমূলক কাজ করছে, তাদের দায়িত্ব দিতে হবে, যাতে কোনো গ্রাম বা এলাকায় একটি শিশুও স্টু্কলছুট থেকে না যায়। বারবার সমীক্ষা করতে হবে। 'চাইল্ডলাইন' পরিষেবাকেও সক্রিয় করা যায়। নির্যাতিত শিশুর সঙ্গে স্টু্কলছুট শিশুর তথ্যও চাইল্ডলাইনে জানাতে উৎসাহিত করতে হবে সবাইকে। স্টু্কলপড়ূয়াকে স্টু্কলের বাইরে রাখা যে অপরাধ- সে দৃষ্টিভঙ্গি এখন সমাজে তৈরি করা দরকার।
যদি সরকার ও সমাজের যৌথ প্রচেষ্টায় বাস্তবিক সব শিশুকে স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা চলে, তা হলে হয়তো দেখা যাবে অতিমারি-উত্তর বাস্তবতায় আরও বেশি ছেলেমেয়ে নিয়মিত ক্লাস করছে স্টু্কলে। আগে যারা অলক্ষ্যে-অবহেলায় স্টু্কলছুট হতো; বিশেষ নজরদারির ফলে তারাও এখন স্টু্কলে ফিরেছে। যে ছেলেমেয়েরা পড়া না পেরে সর্বদা লজ্জিত, সংকুচিত হয়ে থাকত, তারা শ্রেণি-উপযোগী পাঠ দ্রুত রপ্ত করার ফলে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছে।
ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, কঠিন সময়কে কাজে লাগাতে অনেকটা এগিয়ে যায় মানুষ। অতিমারি তেমনই একটা সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের সামনে। এ সুযোগ সত্যিই কাজে লাগাতে পারলে হয়তো দেখা যাবে, আগামী বছরগুলোতে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে যে পাঁচ লাখ শিশু প্রতি বছর স্টু্কলের পাঠ শেষ হওয়ার আগেই 'নিখোঁজ' হয়ে যায়, তারা সবাই থেকে যাচ্ছে শ্রেণিকক্ষে, স্টু্কলের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত। এখন পূজার পরে স্টু্কল খোলার অপেক্ষা।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, যুক্তরাষ্ট্র। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে পুনঃপ্রকাশিত
এ ব্যাপারে 'প্রথম' স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির শিক্ষা পদ্ধতি বেশ কাজে লাগে, তা প্রমাণিত। এ সংস্থার কর্মীরা প্রথমেই একটি পরীক্ষার মাধ্যমে পড়ূয়ার ক্ষমতার ধাপ নির্ধারণ করে নেয় (যেমন- শিশুটি অক্ষর চেনে না। অথবা অক্ষর চেনে কিন্তু শব্দ পড়তে পারে না, কিংবা শব্দ পড়তে পারে কিন্তু বাক্য পারে না)। তারপর একই ধাপের ছেলেমেয়েদের একটি দলে নিয়ে এসে তাদের উপযোগী পাঠ পড়ায়। ওই শিশুরা বয়স অনুসারে স্টু্কলের নানা শ্রেণির পড়ূয়া হতে পারে, কিন্তু লেখাপড়ার পাঠ নেয় একসঙ্গে। যে নিজের ধাপের দক্ষতা আয়ত্ত করে ফেলে, সে চলে যায় পরবর্তী দলে। দেখা গেছে, এমন করে কয়েক মাসের মধ্যে হয়তো কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়ে প্রায় শ্রেণি-উপযোগী দক্ষতায় পৌঁছে যায় ছেলেমেয়েরা। দীর্ঘ অনভ্যাসের ফলে বহু পড়ূয়া সম্ভবত শ্রেণি-উপযোগী লিখতে-পড়তে পারার ক্ষমতা হারিয়েছে। তাই এখন এ পদ্ধতি বিশেষ কাজে লাগতে পারে। তৃতীয় শ্রেণির পড়ূয়াকে শুরু করতে হতে পারে প্রথম শ্রেণির পাঠ থেকে, পঞ্চম শ্রেণির পড়ূয়াকে দ্বিতীয় থেকে। শ্রেণির সিলেবাস ধরে পড়াতে গেলে তার সুযোগ মিলবে না। প্রতিটি ছেলেমেয়ে লিখতে-পড়তে, অঙ্ক করতে পারার ক্ষমতা রপ্ত যাতে করতে পারে, তা নিশ্চিত করাই স্কুল শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার। যে কোনো সময়েই এটা সত্য, কিন্তু এখন এটা না করলেই নয়।
দ্বিতীয় কাজ হলো, প্রতিটি শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে আসা। এ বিষয়ে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে সরকার একটা স্লোগান তৈরি করতে পারে, যা শতভাগ শিশুকে স্টু্কলে ফেরানোর ডাক দেবে। একটি শিশুও যেন বাড়ি, ফসলের ক্ষেত, দোকান-বাজার, কল-কারখানায় থেকে না যায়। বিশেষত স্কুলপড়ূয়া মেয়েদের বাড়ির কাজ থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে স্টু্কলে। কাজটা সহজ হবে না, কারণ বহু পরিবার অতিমারির জেরে রোজগার হারিয়েছে। কাল যারা ছিল স্টু্কলপড়ূয়া, আজ তাদের কেউ মায়ের সঙ্গে লোকের বাড়িতে কাজে যাচ্ছে, কেউ বাবার দোকান সামলাচ্ছে, কেউ বাড়ি থেকে দূরে চলে গেছে রোজগারের আশায়। কিন্তু এই শিশুদের হারিয়ে ফেলা চলবে না। অতিমারির কঠিন সময়ে কিছু শিশু তো স্কুলছুট হবেই- এমন মনোভাব দেখা দিলে তা হবে শিশুর জন্য ভয়ংকর, এমনকি দেশের জন্যও। প্রত্যেক শিশুকে ফিরতে হবে স্কুলে- এই অঙ্গীকার হতে হবে শর্তহীন, সংশয়হীন। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করতে হলে দরিদ্র শিশুকে স্টু্কলে ফেরাতেই হবে; কাজে পাঠানো চলবে না।
দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর সব শিশুকে যেমন ফিরিয়ে আনা চাই, তেমনি সব শিশুর নিয়মিত স্টু্কলে আসাও নিশ্চিত করা চাই। মুশকিল হলো, স্টু্কলের রেজিস্টার দেখে শিশুদের প্রকৃত উপস্থিতি সব সময় বোঝা যায় না। স্টু্কলে সব পড়ূয়াকে নিয়ে আসা এবং তাদের নিয়মিত পঠন-পাঠনের অংশীদার করে তোলার জন্য দরকার স্টু্কলগুলোর ওপর নজরদারির একটা ব্যবস্থা। এখন গ্রাম-শহরের প্রতিটি স্কুলে নজরদারি চাই। তাই অন্যান্য সমাজ-সংগঠনকেও জড়িয়ে নিতে হবে। যেসব এনজিও শিক্ষাসহ সমাজকল্যাণমূলক কাজ করছে, তাদের দায়িত্ব দিতে হবে, যাতে কোনো গ্রাম বা এলাকায় একটি শিশুও স্টু্কলছুট থেকে না যায়। বারবার সমীক্ষা করতে হবে। 'চাইল্ডলাইন' পরিষেবাকেও সক্রিয় করা যায়। নির্যাতিত শিশুর সঙ্গে স্টু্কলছুট শিশুর তথ্যও চাইল্ডলাইনে জানাতে উৎসাহিত করতে হবে সবাইকে। স্টু্কলপড়ূয়াকে স্টু্কলের বাইরে রাখা যে অপরাধ- সে দৃষ্টিভঙ্গি এখন সমাজে তৈরি করা দরকার।
যদি সরকার ও সমাজের যৌথ প্রচেষ্টায় বাস্তবিক সব শিশুকে স্কুলে ফেরানোর চেষ্টা চলে, তা হলে হয়তো দেখা যাবে অতিমারি-উত্তর বাস্তবতায় আরও বেশি ছেলেমেয়ে নিয়মিত ক্লাস করছে স্টু্কলে। আগে যারা অলক্ষ্যে-অবহেলায় স্টু্কলছুট হতো; বিশেষ নজরদারির ফলে তারাও এখন স্টু্কলে ফিরেছে। যে ছেলেমেয়েরা পড়া না পেরে সর্বদা লজ্জিত, সংকুচিত হয়ে থাকত, তারা শ্রেণি-উপযোগী পাঠ দ্রুত রপ্ত করার ফলে আত্মবিশ্বাস খুঁজে পাচ্ছে।
ইতিহাস বারবার দেখিয়েছে, কঠিন সময়কে কাজে লাগাতে অনেকটা এগিয়ে যায় মানুষ। অতিমারি তেমনই একটা সুযোগ এনে দিয়েছে আমাদের সামনে। এ সুযোগ সত্যিই কাজে লাগাতে পারলে হয়তো দেখা যাবে, আগামী বছরগুলোতে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পশ্চিমবঙ্গে যে পাঁচ লাখ শিশু প্রতি বছর স্টু্কলের পাঠ শেষ হওয়ার আগেই 'নিখোঁজ' হয়ে যায়, তারা সবাই থেকে যাচ্ছে শ্রেণিকক্ষে, স্টু্কলের শেষ পরীক্ষা পর্যন্ত। এখন পূজার পরে স্টু্কল খোলার অপেক্ষা।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি, যুক্তরাষ্ট্র। কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা থেকে ঈষৎ সংক্ষেপে পুনঃপ্রকাশিত