ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধ তারুণ্যের জয়যাত্রা

মুক্তিযুদ্ধ তারুণ্যের জয়যাত্রা

কোলাজ ::বোরহান আজাদ

রোমাঞ্চ তালুকদার

প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২২ | ০০:০৪

ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। যে বিজয় এসেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের হাত ধরে। ১৯৭১ সালে একটি গণতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশের তরুণরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধে। এ সময়ের তরুণরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি; তবে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ তরুণদের অনেকেই কাজ করছেন সমাজ ও দেশের জন্য। তাঁরা নানাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরছেন বিশ্বের সামনে। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানাতে গড়ে তুলেছেন ডিজিটাল আর্কাইভ। তৈরি করছেন ভিডিও গেমস। নাটক, সিনেমা এবং প্রামাণ্যচিত্রের মাধ্যমেও অনেক তরুণ মুক্তিযুদ্ধকে তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাঁদের সেসব প্রচেষ্টা নিয়েই আজকের আয়োজন।

সাব্বির ও শান্তার মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ
স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া দুই তরুণ সাব্বির হোসাইন ও শান্তা আনোয়ার। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, কেবল বই পড়ে আর বড়দের কাছে মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা শুনে বড় হয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের এই আত্মত্যাগে উদ্বুদ্ধ হয়ে দুই তরুণ একসময় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস খোঁজ করেছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ইতিহাস সংগ্রহশালায়। তারপর নিরলস প্রচেষ্টা ও গবেষণা শেষে একসময় মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য নিয়ে গড়ে তোলেন 'মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ'। মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টের আওতায় প্রতিষ্ঠিত এই আর্কাইভে প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে সাব্বির হোসেন এবং সভাপতি হিসেবে শান্তা আনোয়ার দায়িত্ব পালন করছেন। অনলাইনভিত্তিক এই ভার্চুয়াল সংগ্রহশালায় রয়েছে- মুক্তিযুদ্ধের দলিল, মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেট, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার পত্রপত্রিকা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বই, তথ্যচিত্র, ভিডিও ফুটেজ, চলচ্চিত্র, দুর্লভ অডিও এবং আলোকচিত্রের ডিজিটাল সংস্করণ।

এই লাইব্রেরি থেকে চাইলে যে কেউ বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস পাঠ ও দুর্লভ সংগ্রহ নিয়ে গবেষণা করতে পারেন। ডিজিটাল এই গণগ্রন্থাগার ও আর্কাইভে বর্তমানে ১২ জন গবেষক-কর্মী কাজ করছেন। ২০০৭ সাল থেকে সাব্বির ও শান্তা 'বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্র' নামে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সব দলিল দস্তাবেজ সংগ্রহ শুরু করেন। ২০১৪ সালে পরীক্ষামূলক চালু হলেও ২০১৬ সালের নভেম্বরে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ডিজিটাল গণগ্রন্থাগার মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ। বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরায় দেশ-বিদেশ থেকে পেয়েছেন স্বীকৃতি। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইক্সেটারের হিউম্যানেটিস কলেজের 'দ্য ইক্সেটার সাউথ এশিয়া সেন্টার' তাদের একাডেমিক রিসোর্স ম্যাটেরিয়াল সেকশনে মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ট্রাস্টকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ পাঠক মুক্তিযুদ্ধ ই-আর্কাইভ ব্যবহার করেছেন।

ওয়াহিদ ইবনে রেজার সারভাইভিং '৭১
সেলুলয়েডের পর্দায় বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের আবেগ ও অনুভূতির অসংখ্য গল্প। এরই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম অ্যানিমেশন সিনেমা- সারভাইভিং '৭১। এই অ্যানিমেশন সিনেমাটিতে নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছেন- জয়া আহসান, মেহের আফরোজ শাওন, তানযীর তুহিন, গাউসুল আলম শাওন, সামির আহসান, অনিক খান ও ওয়াহিদ ইবনে রেজা। সিনেমাটির টিজারে অতিথি শিল্পী হিসেবে কণ্ঠ দিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, আরিফ আর হোসাইন, সাদাত হোসাইন এবং কাজী পিয়াল। এর কনসেপ্ট আঁকা হয়েছে মডেলের ওপর ভিত্তি করে। এই অ্যানিমেশন সিনেমাটি তৈরি করেছেন তরুণ নির্মাতা ওয়াহিদ ইবনে রেজা। আগামী বছরের মাঝামাঝি এটি মুক্তি পেতে পারে বলে জানিয়েছেন তরুণ এ নির্মাতা।

প্রথম আন্তর্জাতিক সিনেমা জেকে ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রথম আন্তর্জাতিক সিনেমা 'জেকে ১৯৭১'। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষকে সহায়তার জন্য ফরাসি যুবক জ্যঁ কুয়ে ছিনতাই করেছিলেন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স বা পিআইএর একটি যাত্রীবাহী বিমান; এ সত্য ঘটনার অবলম্বনেই নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। তাঁর দাবি মেনে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের জন্য ২০ টন ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ওই বিমানে তুলে দিলেই কেবল মুক্তি পাবেন বিমানের সব যাত্রী। এই ঐতিহাসিক সত্য ঘটনা অবলম্বনেই নির্মিত হয়েছে সিনেমাটি। সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন ফাখরুল আরেফীন খান। সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পশ্চিমবঙ্গের সৌরভ শুভ্র দাশ। এ ছাড়া অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্রান্সিসকো রেমন্ড এবং রাশিয়ান অভিনেত্রী ডেরিয়া গভ্রুসেনকো ও অভিনেতা নিকোলাই নভোমিনাস্কি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে আরও অভিনয় করেছেন- সব্যসাচী চক্রবর্তী, ইন্দ্রনীলসহ প্রায় ৩৬ জন অভিনয়শিল্পী। আগামী বছরের শুরুতেই মুক্তি পেতে পারে কাঙ্ক্ষিত এই সিনেমা!

মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত তিন ভিডিও গেম
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে তরুণরা তৈরি করেছেন বেশ কয়েকটি ভিডিও গেম। কম্পিউটার গেমের পাশাপাশি স্মার্টফোনেও খেলা যাচ্ছে এ গেমগুলো। ভিডিও গেমসের হাত ধরে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সহজেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে যাবে। লিবারেশন ৭১ :২০১৪ সালের ২৬ মার্চ অবমুক্ত হয় এই ভিডিও গেমটি। ২০১২ সালে ৩০ জন স্বেচ্ছাসেবী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় এ গেমের নির্মাণকাজ। 'টিম ৭১'-এর তরুণ নির্বাহী কর্মকর্তা ফারহাদ রাকিবের নেতৃত্বে এ উইন্ডোজ গেম তৈরি করা হয়। হিরোস অব ৭১ :১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের আবহে এক কাল্পনিক ঘটনার ওপর তৈরি করা প্রথম মোবাইল গেম 'হিরোস অব ৭১'। অ্যান্ড্রয়েড প্ল্যাটফর্ম উপযোগী এই গেম তৈরি করে পোর্টব্লিস নামে একটি ফ্রিল্যান্সার গ্রুপ। ওয়ার ৭১ :ফার্স্ট ডিফেন্স : দেশে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রযুক্তিতে মহান মুক্তিযুদ্ধের ওপর নির্মিত প্রথম গেম এটি। বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষাতেই গেমটি প্লে করা যায়। গেমটি ডেভেলপ করেছে ডিজিটালবি লিমিটেড।

এ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অসংখ্য কাজ করছেন তরুণরা। স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস আর বিস্ময়কর সব ঘটনা নানাভাবে তুলে ধরছেন তাঁরা। তাই এই তরুণদের নিয়ে আমরা স্বপ্ন দেখি লাল-সবুজের বিশ্বজয়ের।

আরও পড়ুন

×