ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

শিবির থেকে

কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব জানি না

কবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরব জানি না

সাইফুল্লাহ রোস্তাম, ডুইসবার্গ (জার্মানি) থেকে

প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০২২ | ১৪:৩৪

ইউক্রেন ছেড়েছি আজ দেড় মাস। বহু পথ পাড়ি দিয়ে এখন আছি জার্মানির ডয়েশবার্গে শরণার্থী শিবিরে। ইউক্রেনে ছিলাম অভিবাসী। এখানে এসে হয়েছি শরণার্থী। তবে ভালো আছি। আমার মতো অন্য বাংলাদেশিরাও ভালো আছেন। কতদিন ভালো থাকব, তা নিয়ে সংশয় আছে।

ইউক্রেনে থাকা শরণার্থীদের প্রতি ইউরোপিয়ানদের যে সহমর্মিতা ছিল, তা কিন্তু দিন দিন কমে আসছে। বাস্তবতার ধাক্কায় আগামী দিনগুলোতে আরও কমবে। এখন স্বাগত জানালেও পরে আমাদের মতো শরণার্থীদের কী হবে?

এ কথা সত্য, আমার মতো অনেক বাংলাদেশি জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্সের মতো দেশে থিতু হতে নিজের দেশ ছেড়েছিলাম, ইউক্রেনে থাকতে নয়। যুদ্ধ আমাদের সেই সুযোগ করে দিয়েছে বটে, তবে ফেলেছে অতল অনিশ্চয়তায়। কবে এই শরণার্থী শিবিরের জীবন শেষ হবে, কবে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরব, আবার কবে কাজ করে উপার্জন করব, দেশে পরিবারের কাছে টাকা পাঠাব- এসব প্রশ্নের জবাব খুঁজে শরণার্থী শিবিরে একঘেয়ে সময় পার করছি।

আমি থাকতাম পূর্ব ইউক্রেনের দিনিপ্রোপেত্রভস্কের ছোট্ট শহর নিকপোলে। প্রায় পাঁচ বছর ছিলাম সেখানে। বাংলাদেশের মৌলভীবাজার শহর থেকে ২০ বছর বয়সে সরাসরি এসে থিতু হয়েছিলাম এই শহরে। কাজ করতাম কারখানায়। দেশে মা-বাবা, তিন বোন আমার ওপর নির্ভরশীল। ভালোই দিন কাটছিল। এ বছরের শুরু থেকেই উত্তেজনা ছিল, কিন্তু রাশিয়া যে সরাসরি হামলা করবে, তা কেউ ভাবেনি। কিন্তু হামলা শুরুর পর সব হিসাব পাল্টে যায়।

২৭ ফেব্রুয়ারি পোল্যান্ডের উদ্দেশে নিকপোল ছাড়ি। আমার সঙ্গে এক বাংলাদেশি বোন ও তার চার বছর বয়সী শিশুকন্যা। যার স্বামী আটকা পড়েছিলেন পোল্যান্ডে। নিকপোল থেকে ট্রেনে পোল্যান্ডের লিভিভ সীমান্তের ৩৫ কিলোমিটার আগে নেমে পড়ি। পরের পথটুকু নির্বিঘ্ন না হলেও বহু মানুষের সহানুভূতি পেয়েছিলাম। সঙ্গে শিশু থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের গাড়ি করে পাঁচ-দশ কিলোমিটার করে পথ এগিয়ে দেন সীমান্তের দিকে।

পথে পথে ছিল স্বেচ্ছাসেবীদের ভিড়। যারা যুদ্ধক্ষেত্র ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডের দিকে ছুটছিলেন, তাদের খাবার, শীতবস্ত্র দিয়ে সহায়তা করছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা। 'মানুষ মানুষের জন্য'- এ কথা বারবার মনে হয়েছে সেই পথে। পোল্যান্ড সীমান্তও নির্বিঘ্নে খুব কম সময়ে পার হই। শরণার্থীর কাগজপত্রও পেয়ে যাই।

পোল্যান্ডের কথা কখনও ভুলব না। সীমান্তের এপারে হাজারো স্বেচ্ছাসেবী অপেক্ষায় ছিল। রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছিল- কে কীভাবে শরণার্থীদের সহযোগিতা করবেন। রেস্টুরেন্টগুলোতে বিনামূল্যে খাবার দেওয়া হচ্ছিল। আমাকে আশ্রয় দিল দানিয়েল নামে এক পোলিস নাগরিক। একেবারে বিনামূল্যে থাকা-খাওয়ার সুযোগ ছিল তার বাড়িতে। ইউরোপে এমন আতিথেয়তার কথা ভাবাই যায় না।

স্বেচ্ছাসেবীদের যখন জানালাম, পোল্যান্ড থাকব না, জার্মানি যাব। এক দিনের মধ্যে ওয়ারশ থেকে বার্লিনের বিমানের টিকিট করে দিল। একটি টাকাও নিল না। বার্লিন বিমানবন্দরে নামার পরও চমৎকার আতিথেয়তা পেলাম। ইউক্রেন যুদ্ধের ভয়াবহতা জার্মানিতে আসার পর এখানকার মিডিয়ার মাধ্যমে জানতে পারি। এখানকার সংবাদমাধ্যম ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে যত কথা প্রচার করছে, তা ইউক্রেনে বসেও জানার সুযোগ নেই। আবার কিছু ক্ষেত্রে অতিরঞ্জিত খবর ছড়াচ্ছে।

বার্লিন বিমানবন্দর থেকে বেরুনোর পর এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হলো। এক তরুণ ও তরুণী আমার পিছু নিলেন। কিছু দূর যাওয়ার পর তারা জানতে চাইলেন, আমার সহযোগিতা প্রয়োজন কিনা? যখন বললাম, আমার যাওয়ার মতো জায়গা নেই, তারাই দায়িত্ব নিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ বেনিয়ামিন এবং জার্মান তরুণী লারা ভেন্টটিউর দম্পতি আমার দায়িত্ব নিলেন। ২১ দিন ছিলাম তাদের বাড়িতে। এখানেও থাকা-খাওয়া সব ফ্রি। হাজার হাজার জার্মান পরিবার এভাবে শরণার্থীদের সহায়তা করছে। আশ্রয়, খাবার, শীতবস্ত্র সব দিচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে মানুষের প্রতি মানুষের এমন সহমর্মিতা দেখা যায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে বর্ণবাদী নানা ঘটনা ও শ্বেতাঙ্গ শরণার্থীদের প্রাধান্য দেওয়ার খবর শোনা গেলেও, আমার ক্ষেত্রে তা ঘটেনি।

২২তম দিনে বার্লিন থেকে নেদারল্যান্ডসের সীমান্তের কাছাকাছি ডয়েশবার্গে আনা হয় আমাদের। আমাদের মানে শরণার্থীদের। সেই ২৩ মার্চ থেকে এখনও এখানেই আছি। ১০ ফুট বাই ১০ ফুটের কক্ষে আমরা দু'জন আছি। আমার সঙ্গী ইউক্রেনের নাগরিক। শরণার্থী শিবিরে সেই অর্থে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এখানে সময় কাটে না। কাজ নেই। মাঝেমধ্যে অনুমতি নিয়ে ক্যাম্প থেকে বের হই। আশপাশে ঘুরেফিরে দেখি।

এখন শুনছি আমাদের জার্মানিতেই পুনর্বাসন করা হবে। প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী জার্মানিতে এসেছেন। বাংলাদেশিদের প্রায় সবাই জার্মানি ও ফ্রান্সে আশ্রয় নিয়েছেন। তবে যারা পোল্যান্ডে থেকে গেছেন, তারাই ভালো আছেন। সেখানে কাজের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। জার্মানিতে আমাদের আগে ভাষা শেখানো হবে। তারপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর কাজের অনুমতি দেওয়া হবে। শুনছি, আমাদের জন্য বাড়ির ব্যবস্থাও করা হবে। এখন শরণার্থী হিসেবে মাসে ৩০০ ইউরো ভাতা দিচ্ছে। তা দিয়ে তো জীবন চলবে না। দেশে থাকা পরিবারেরও চলবে না। দেশে ফিরে গিয়ে যে কিছু করব, সেই উপায়ও নেই। যুদ্ধ আমাকে জার্মানিতে ঠেলে দিয়েছে। পাঁচ বছর আগে এখানেই তো আসতে চেয়েছিলাম। সেই চাওয়া পূরণ হয়েছে। কিন্তু স্বাভাবিক মুক্ত আত্মনির্ভর জীবন কবে ফিরে পাব, তা অজানা।

আরও পড়ুন

×