ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

প্রকৃতিপ্রেম

মরুর বুকে কৃত্রিম বনে রেজা খানের ৪০ বছর

মরুর বুকে কৃত্রিম বনে রেজা খানের ৪০ বছর

দুবাইয়ের আল কুদরা বনে ক্ষুদ্র লেজার্ডের সঙ্গে দারুণ সখ্য ড. রেজা খানের সমকাল

 কামরুল হাসান জনি, ইউএই 

প্রকাশ: ০৭ অক্টোবর ২০২৪ | ২৩:৩৭

বয়স ৮০ ছুঁইছুঁই হলেও শারীরিক গঠনে তিনি তরুণ। প্রতিদিন সকাল হয় যেন একই নিয়মে। ব্যক্তিগত ক্যামেরা হাতে ভোরের স্নিগ্ধ বাতাসে ছুটে যান মরুর বুকে তৈরি কৃত্রিম বনে। দুবাইয়ের ‘আল কুদরা’ বনে অতিথি পাখি দলবেঁধে ছোটাছুটি করে। সংযুক্ত আরব আমিরাতে এভাবেই বন্যপ্রাণীর সঙ্গে ড. রেজা খানের কেটে গেছে ৪০ বছর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়ে ১৯৮৩ সালে দুবাইয়ের আল আইন চিড়িয়াখানায় চাকরি নেন তিনি। পশুপাখি নিয়ে গবেষণায় কাটিয়েছেন সময়। একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে দুবাই চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপক পদে চাকরি পেয়ে তিনি আলোচনায় আসেন। কাজ করেন টানা ৩৫ বছর। এ সময় রেজা খান অভিজ্ঞতার ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন, পেয়েছেন পদোন্নতি। সান্নিধ্য পেয়েছেন আরব শাসকদের। সেই অভিজ্ঞতা থেকে পরিকল্পনা দেন দুবাই সাফারি পার্ক নির্মাণের, যা এখন দেশটির অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র।

এক সন্ধ্যায় দুবাইয়ে সমকালের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বর্ণনা করেন নানা অভিজ্ঞতা। জানান কর্মজীবন ও মরুর দেশে বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে। ১৯৮৯ সালের জুনে রেজা খান ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন দুবাই চিড়িয়াখানায়। দুই বছর পর হন চিড়িয়াখানার প্রধান। ২০০৯ সাল পর্যন্ত এ পদে বহাল থাকেন। এর পর হন প্রধান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ।
বর্তমানে রেজা খান দুবাই সাফারি পার্কের প্রধান বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৯৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত এ নিয়ে মহাপরিকল্পনা হয়। বিশ্বের বড় প্রাণীগুলো একসঙ্গে দেখানোর পরিকল্পনা করে এগিয়ে নেওয়া হয় সাফারি পার্কের কাজ। জায়গা বরাদ্দ হয় ২০১২ সালে। দুবাইয়ের শাসক শেখ মুহাম্মদ বিন রাশেদ আল মাকতুম ১৫ কোটি দিরহাম ব্যয়ে দুবাই মিউনিসিপ্যালিটিকে প্রাথমিক কাজ এগিয়ে নেওয়ার নির্দেশনা দেন। সাফারি পার্কে অ্যারাবিয়ান, আফ্রিকান ও এশিয়ান ভিলেজ আছে। সেখানে উন্মুক্ত প্রাণীদের দেখতে ঘুরতে হবে গাড়িতে করে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত এ সাফারি পার্কের উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞও ছিলেন রেজা খান। তিনি এবং গ্রিস ও মালয়েশিয়ার দু’জন বনের নকশা করেন। তাদের পরিকল্পনায় তৈরি করা হয় কৃত্রিম বন। নির্দিষ্ট অঞ্চলের বন্যপ্রাণীর জন্য ওই অঞ্চলের গাছপালা রোপণ করা হয়। ছোট গাছের পাশাপাশি বড় জাতের গাছ রোপণ করা হয়।
রেজা খান জানান, দীর্ঘ কর্মজীবনে তাঁকে চিড়িয়াখানার জন্য খুব বেশি বন্যপ্রাণী কিনতে হয়নি। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে পশুপাখি বিনিময় হয়েছে। তাঁর হাত ধরে আল আইন চিড়িয়াখানার যেমন উন্নতি হয়েছে, তেমনি ব্যাপ্তি বেড়েছে দুবাই চিড়িয়াখানারও। তিনি জানান, চিড়িয়াখানার প্রাণীগুলো বিভিন্ন লোকজনের দেওয়া। প্রজননের মাধ্যমে এগুলোর সংখ্যা বেড়েছে। এ ছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে জব্দ প্রাণীও দুবাই চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হতো। এভাবে গরিলা এবং শিম্পাঞ্জিও এসেছে।

দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় বাসিন্দা, সংবাদমাধ্যম কিংবা চিড়িয়াখানা-সংশ্লিষ্টদের কাছে রেজা খান হয়ে ওঠেন নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি। বন্যপ্রাণী শনাক্ত করা ও তাদের সম্পর্কে জানতেও অনেকে ছুটে আসেন তাঁর কাছে। ব্যক্তিগত ক্যামেরা সঙ্গে থাকায় তাঁর তোলা বন্যপ্রাণীর অনেক ছবি স্থান পায় গণমাধ্যমে। লেখেন বন্যপ্রাণীর জীবনচিত্র নিয়ে নানা গবেষণাপত্র।
প্রাণী বিশেষজ্ঞ রেজা খানের উদ্ভিদ ও বন বিষয়ে নিবন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য। তাঁর লেখা ‘বাংলাদেশের বন্যপ্রাণী’র তিন খণ্ড প্রকাশ করেছে বাংলা একাডেমি। চিড়িয়াখানার ব্যবস্থাপনা, বাংলাদেশের সাপ, বন্যপ্রাণী নিয়ে বই লেখেন তিনি। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘স্থলভাগের বৃহত্তর প্রাণী হাতি’, ‘পাখিবিশারদ সালিম আলী’, ‘বাংলাদেশের সাপ’, ‘বাংলাদেশের বানর-নরবানর’, ‘আমাদের পাখির রাজ্য’। দেশে বাংলা ভাষায় ১৫টি, ইংরেজিতে ১০টি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইংরেজিতে চারটি বই প্রকাশ হয়েছে তাঁর।
ড. রেজা খান ঢাকা জেলার বালিয়া গ্রামের বড়বাড়িতে ১৯৪৫ সালের ১৭ নভেম্বর জন্ম নেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ভারতের বিখ্যাত পক্ষীবিদ ও প্রকৃতিপ্রেমী সালিম মঈজুদ্দীন আবদুল আলীর সঙ্গে কাজ করেছেন। 

আরও পড়ুন

×