ইসরায়েলের দর্প কি চূর্ণ হয়ে যাচ্ছে

ইসরায়েলের বীরশেবা এলাকায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের মিসাইল আঘাত হানে (ছবি-এএফপি)
অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৫ | ১১:২৬ | আপডেট: ২১ জুন ২০২৫ | ১১:৪৫
মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল এক অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবে পরিচিত। সামরিক ও অর্থনৈতিক সক্ষমতায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশকে তারা তোয়াক্কা করেনি। ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশটির আয়তন শুধুই বেড়েছে। বছরের পর বছর আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করে ফিলিস্তিনি ভূমি দখলের কাজ চালিয়ে গেছে। আরব দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ ও বিজয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু ইরানের সঙ্গে চলমান যুদ্ধ ইঙ্গিত দিচ্ছে, ইসরায়েলের স্বাতন্ত্র্য ভাবমূর্তির দিন শেষ হয়ে আসছে।
প্রায় দুই বছর ধরে নেতানিয়াহুর নেতৃত্বে ইসরায়েল প্রতিবেশীদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। হামলা ও দ্রুত প্রতিশোধের এই নীতি এই অঞ্চলে দেশটিকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছে। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের হামলার পর ইসরায়েল শক্তি দেখাতে শুরু করে। তারা এমন আক্রমণাত্মক যুদ্ধ পরিচালনা করে যে, দীর্ঘদিনের শত্রু হামাস দুর্বল হতে বাধ্য হয়। এতে যুদ্ধের উত্তেজনা গোটা মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে। একদিকে হামাস, অন্যদিকে লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সর্বাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নেতানিয়াহুর বাহিনী। সেই যুদ্ধের শেষ প্রান্ত ইরানে গিয়ে ঠেকেছে। ইরানে গত ১৩ জুন নজিরবিহীন হামলা করে বসে ইসরায়েল।
হামলার গতি এত ক্ষিপ্র ছিল যে, ইরানের প্রথম সারির জেনারেল ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের নিশ্চিহ্ন করে দেয় তারা। এর পরই ইরানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। জবাবে ইরান মুহুর্মুহু পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে থাকে। ইসরায়েল নিজেই যে ইরানকে যুদ্ধের ময়দানে টেনে এনেছে, সেই ইরানই এখন ইসরায়েলের আধিপত্য চূর্ণ করে দিচ্ছে। ইরানের হামলায় তেল আবিবের পরিস্থিতি গাজার মতোই ভয়ানক হয়ে উঠেছে। তেল আবিবের আকাশে এখন সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি অত্যাধুনিক ড্রোনের মিছিল। যুদ্ধের এই উত্তেজনা ইহুদি রাষ্ট্রটিকে মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে ইরান দীর্ঘদিন ধরে ধৈর্য দেখিয়েছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ইসরায়েলের পাশে থাকায় তাদের ভয় ছিল। কয়েক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির উপস্থিতিও এই ভয়ের কারণ। কিন্তু এখন ইরান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ায় তাদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন তারা ইসরায়েলকেই নিশ্চিহ্ন করার হুমকি দিচ্ছে। এতদিন দুটি কারণে ইসরায়েল আধিপত্য দেখিয়ে এসেছে। একটি যুক্তরাষ্ট্রের অটল সমর্থন এবং অন্যটি নিজস্ব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, সামরিক শক্তি ও অনন্য সামাজিক মডেল। তবে বর্তমানে দ্বিতীয় স্তম্ভটি দুর্বল হয়ে পড়েছে। দেশটি ক্রমবর্ধমান নেতিবাচক অভিবাসনের মুখোমুখি হচ্ছে। ২০২৪ সালে ইসরায়েল থেকে ৮২ হাজার ৭০০ নাগরিক দেশ ত্যাগ করে, যা আগের বছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বেশি। এখানে আশঙ্কার বিষয় হলো, অদক্ষ বা কর্মহীনরা দেশত্যাগ করছে না। দেশত্যাগ করছে তরুণ ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠী।
অথচ একটি আধুনিক রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখতে যাদের প্রয়োজন, তারাই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ইসরায়েলের সংকট বহুমুখী। দেশটি একটি ক্ষয়িষ্ণু নব্য-উদারনৈতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভারে চাপা পড়ে যাচ্ছে। যুদ্ধ, মহামারিসহ নানা সংকট পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে তুলছে। ক্রমাগত জরুরি অবস্থার মধ্যে দেশ শাসন ও সংঘাতের অবিরাম প্রস্তুতি দেশটিকে এক ভয়ানক ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েল পশ্চিমাদের শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মধ্যপ্রাচ্যে যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চায়, সেই যুদ্ধের ঘুঁটিতে পরিণত হয়েছে দেশটি।
সংঘাত কেবল একটি কৌশল নয়, ইসরায়েলিদের জীবনযাত্রার একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক বিজয় পেতে যুদ্ধকেই সঙ্গী করে নিয়েছেন নেতানিয়াহু। যুক্তরাষ্ট্র পরাশক্তি চীন-রাশিয়ার সঙ্গে আধিপত্য কায়েমের লড়াইয়ে ইসরায়েলকে দিয়েই প্রক্সিযুদ্ধ চালাচ্ছে। স্থায়ী যুদ্ধ পরিস্থিতি বজায় রাখতে ইসরায়েল এখন নিজস্ব সম্পদ ক্ষয় করতে লিপ্ত। প্রযুক্তিগত ও নাগরিক অগ্রগতির এক সময়ের গর্বিত মডেলটি এখন আগের মতো কাজ করছে না। দেশটিকে কেবলই এখন রাজনৈতিক, সামরিক ও আর্থিকভাবে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপবিভাগ হিসেবে টিকে আছে।