সময় এখন বৃক্ষমেলার

এখানে বিদেশি গাছের ভিড়ে দেশি-গবেষণার সুস্বাদু আম ‘বারি-ফোর’ও রয়েছে
জায়েদ ফরিদ
প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৪ | ০৬:৪৫ | আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৪ | ১৫:১৩
বর্তমানে নার্সারি ছেয়ে আছে বাংলাদেশের সর্বত্র। সরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান ছাড়াও ঢাকার অদূরে দিয়াবাড়ী, সাভার-গাজীপুরের চারাবাগ, আইটর, লালমাঠ প্রভৃতি এলাকায় নার্সারির ছড়াছড়ি। দিয়াবাড়ীতে ভ্রমণবিলাসী এক বিদেশিনীর মন্তব্য খুব প্রাণে বেজেছে আমার। তাঁর মনে হয়েছে– বাংলাদেশের মানুষ প্রাণ দিয়ে সবুজ ভালোবাসে, পৃথিবীতে এত নার্সারি বোধ হয় আর কোথাও নেই এবং এ মুহূর্তে বাংলাদেশকে বলা যায়, ‘নার্সারি ল্যান্ড অব দি ইউনিভার্স’। নির্বনায়নের দিন শেষ হয়েছে, এখন বনায়নের যুগ। এ দেশে সবুজের অনুপাত যত শতাংশই বাকি থাকুক, এর প্রতি আমাদের ভালোবাসায় তা দ্রুত পূরণ হতে বাধ্য।
বৃক্ষমেলা বঙ্গবন্ধু চীন-মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রের পশ্চিমপাশে প্রতিবছর এমন সময়েই অনুষ্ঠিত হয়। বৃষ্টি-ঋতুতে জল সিঞ্চনের ঝামেলা নেই আর যারা জমিতে গাছ লাগাবেন, তারা এই বৃষ্টিতে রোপণ করলেই গাছ বেঁচে যায়। এবারের বৃক্ষমেলার সময়টা একটু বেশি, ৫ জুন থেকে ১৩ জুলাই পর্যন্ত, ঈদের সামান্য সময় বাদ দিয়ে। দেখতে অন্যান্য বছরের মতো প্রায় একই রকম, আইলের পাশে সারিবদ্ধভাবে বিদেশি আমগাছের সারি; যেখানে রয়েছে চিয়াংমাই, কিউজাই, মিয়াজাকি, ব্যানানা, ব্রুনাই কিং ইত্যাদি জাতের গাছ। এখানে বিদেশি গাছের ভিড়ে দেশি-গবেষণার সুস্বাদু আম ‘বারি-ফোর’ও রয়েছে। ছোটবেলা থেকে আমের স্বাদটা বরাবর টক বা টকমিষ্টি বলেই জেনেছি; কিন্তু এখন তা গবেষণা ও আমদানির কারণে সুমিষ্ট রূপ ধারণ করেছে।
এখানে দেশি হাঁড়িভাঙা, গোবিন্দভোগ, আম্রপালি, কাটিমন, ল্যাংড়া, হিমসাগর, ফজলি আমের গাছও যে নেই তা নয়; তবে নতুন বিদেশি ডোয়ারফ কলমের প্রতিই মানুষের আকর্ষণ বেশি। চোখে পড়েছে, ৬০-৭০টি আমসহ গাছও মানুষ কিনে নিয়ে যাচ্ছে। বিশাল এক গাছ, ঠেলা-ইঞ্জিনে চড়ে গেট পার হচ্ছে– এই অভিনব দৃশ্য উপভোগ করছেন শত শত মানুষ। খরচ বেশি হলেও বিত্তশালী প্রৌঢ় ও অভিজ্ঞ কিছু মানুষ কৌশলে সময়কে যেন কিনে নিতে চেষ্টা করছেন। এক-দুই বছরের চারার পরিবর্তে তারা বেছে নিচ্ছেন ৭-৮ বছরের গাছ। যাবতীয় নার্সারিতে গাছের মূল্য নির্ধারণ করার তিনটি অবস্থা রয়েছে। মোটামুটিভাবে ছোট পলিথিনের চারার মূল্য যদি ৫০০ টাকা হয়, তবে হাফ বস্তার মূল্য হতে পারে তার ২-৩ গুণ আর ড্রামে স্থানান্তর করার সঙ্গে সঙ্গে তার মূল্য হতে পারে ছয় থেকে আট হাজার।
এবারের মেলায় অনেক কাঠগোলাপের গাছ দেখা গেছে। ১ হাজার থেকে ৩-৪ হাজারের মধ্যে হলেও কাঠগোলাপের ক্রেতা আছে। মেলায় এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলো। তিনি এসেছেন কাপাসিয়া থেকে। সেখানে তাঁর একটি সমৃদ্ধ বাগান আছে। তিনি খুঁজছিলেন কৃষ্ণবটের গাছ, যার পাতার গোড়া ঠোঙা আকৃতির। এই গাছের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মিথ–ভগবান কৃষ্ণ নাকি ননী চুরি করে লুকিয়ে রাখতেন পাতার ঠোঙায়। খোঁজাখুঁজি করে গাছ পাওয়া গেল, এক মিটার লম্বা, কিন্তু একটির জায়গায় দুটি করে ঠোঙা, ছোট ছোট। তিনি কিনতে রাজি হলেন ৫০০ টাকায় কিন্তু নার্সারি বলল– এ গাছ বিক্রি হবে না এখন, মাত্র দুয়েকটি গাছই আছে, পরে যোগাযোগ করুন। ঘুরতে ঘুরতে নজরে পড়ল চেনা-অচেনা নানা রকম গাছ, ফুল, ফল বা লতা গাছ– অলস্পাইস, ভাস্কর্য আকারের এডেনিয়াম, নানা জাতের বনসাই, ক্যাকটাস ও ফার্ন, নীল জবা, সুলতান চাঁপা, ডুলি চাঁপা, রোজ ক্যাকটাস, স্বর্ণপদ্ম, আমাজন লিলি, ঢোলসমুদ্র, বাসর লতা, নাগলিঙ্গম ইত্যাদি।
নানা জাতের গোলাপ এবং জবার দেখা পাওয়া গেল মেলায়। সবই হাইব্রিড বা গ্রাফটিং করা, দেশি বসরাই গোলাপের জাতটি আর পাওয়া যায় না, লালবাগ গার্ডেনে অবশ্য এখনও টিকে আছে কিছু। মেলার রাশি রাশি গোলাপের মধ্যে সুগন্ধি গোলাপ খুবই কম। ডাবল ডিলাইট, পাপা মিলান জাতীয় সুগন্ধি গোলাপও আছে, তবে গন্ধ তীব্র নয়। মেলাতে কিছু গোলাপ ফুটন্ত অবস্থায় আছে, যেগুলো বিক্রিও হচ্ছে, তবে গন্ধ শুঁকলে তাতে কেমন যেন চা-পাতার ঘ্রাণ! বোঝা গেল, এগুলোর অধিকাংশই টি-ট্রি হাইব্রিড।
নার্সারি কর্মচারীরা জানান, আবদ্ধ জায়গায় রোদ-বৃষ্টি আর ভ্যাপসা গরমে সারাদিন পরিশ্রম করে তারা ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, মেলা আর এক্সটেনশন না হলেই যেন ভালো, পরিশ্রম হেতু তাদের বোনাস পাওয়ার কথা থাকলেও। সাধারণ একটি নার্সারি গত এক মাসে ৩০ হাজার গাছ বিক্রি করেছে বলে মেলার কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে।
বাংলাদেশে জনগণের মনে গাছ লাগানোর যে সাম্প্রতিক জোয়ার দেখা গেছে, তা ক্রমাগত ফুলে উঠে অব্যবহৃত জমিজিরাতে ঢুকে পড়ছে। এখন যার যেটুকু জায়গা মেলে সেখানেই গাছ লাগানোর চেষ্টা করে। যারা ফ্ল্যাট-বাড়িতে বাস করেন, তাদের সামান্য বারান্দা বা ছাদবাগানে তারা রোপণ করছেন বেলি-গোলাপ, জুঁই, জবা, রুয়েলিয়া, জিজি, ক্যাকটাস ও অর্কিডের গাছ। বাংলাদেশে শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জ, অলিগলি-হালট দ্রুত ঘন সবুজ হয়ে উঠছে। এই সবুজের দিকে তাকালে কেবলই মনে হয় সেই বিদেশিনীর কথা, ‘বাংলাদেশ ইজ নার্সারি ল্যান্ড অব দি ইউনিভার্স’।