২০০ বছরের ঐতিহ্য
সবজি চাষের অনন্য কৌশল

পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার বলদিয়া ইউনিয়নে ভাসমান সবজি বেড
রুবেল নাহিদ
প্রকাশ: ২৬ অক্টোবর ২০২৪ | ০০:০৬ | আপডেট: ৩০ অক্টোবর ২০২৪ | ১০:২২
পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ উপজেলার বিলাঞ্চল নামে খ্যাত বলদিয়া ইউনিয়নের গগন গ্রামের কৃষকদের আধুনিকতার ছোঁয়া স্পর্শ করেনি। সকালে দেশীয় কৃষিকাজের যন্ত্রপাতি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন তারা। খাল-বিলে ভেসে বেড়ানো কচুরিপানাকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছেন ভাসমান সবজি বেড।
বর্ষাকালে কৃষকরা ভাসমান বেড তৈরির কাজে ব্যস্ত থাকেন। আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলেই পানির দেখা মেলে। এ নতুন পানি পেয়ে কৃষকদের কাজের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। ভাসমান বেডের ওপর উৎপাদিত সবজি নিয়ে মিয়ারহাট, স্বরূপকাঠিসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঐতিহ্যবাহী এ ভাসমান সবজির বাজার মেলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির প্রভাবে দক্ষিণের কৃষিজমি পানিতে ডুবছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের কৃষি খাতে যে ক্ষতি হচ্ছে, সেটি মোকাবিলায় সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হতে পারে ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদন। জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে ত্রাতা হিসেবে এ অঞ্চলের মানুষের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছে বাণিজ্যিকভাবে ভাসমান ধাপের ওপর শাকসবজি ও মসলার আবাদ।
কৃষিবিদরা বলছেন, কয়েক দশক ধরেই বরিশাল, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুরসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১০-১২টি জেলার কৃষিজমি পাঁচ-ছয় মাস জলাবদ্ধ থাকে। এ অঞ্চলের ধানি জমিতে অগ্রহায়ণ থেকে বৈশাখ মাস পর্যন্ত বোরো ধানের চাষ হয়। এরপর জ্যৈষ্ঠ-অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত পাঁচ থেকে আট ফুট পানির নিচে নিমজ্জিত থাকে বেশির ভাগ জমি। বর্ষা ও বর্ষার পর এসব এলাকার দুই লাখ হেক্টরের বেশি নিচু জমি পানিবন্দি থাকায় আগে কোনো ধরনের আবাদ হচ্ছিল না।
ভাসমান সবজি চাষি বারেক মিয়া জানান, কচুরিপানার ঘন, লম্বা ও পুরুস্তরের ওপর একটি নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের বাঁশ ফেলে এ বেড তৈরি করা হয়। এরপর বাঁশের ওপর দাঁড়িয়ে শরীরের ভারসাম্য ঠিক রেখে দু’পাশ থেকে কচুরিপানা টেনে এনে বাঁশের ওপর স্তরে স্তরে সাজাতে হয়। কচুরিপানার স্তর সাজানোর সময় কচুরিপানা পানিতে যেভাবে থাকে সেভাবে ঘন করে অর্থাৎ খাড়া করে সাজাতে হবে। অর্ধেক স্তর সাজানোর সময় কচুরিপানা উল্টো করে সাজাতে হবে অর্থাৎ এর শিকড় ওপরের দিকে থাকতে হবে। তারপর পা দিয়ে চেপে চেপে উঁচু স্তর তৈরি করতে হবে; যাতে কোনো গ্যাপ বা ফাঁকা জায়গা না থাকে। এরপর স্তূপের ওপরে উঠে প্রয়োজনীয় কচুরিপানা তুলে মাপ অনুযায়ী ধাপ তৈরি করতে হবে। ধাপের ওপরের অংশে অপেক্ষাকৃত ছোট কচুরিপানা, খুদিপানা, টোপাপানা দেওয়া ভালো। বন্যা, ঢেউ বা জোয়ার-ভাটার স্রোত থাকলে বেডের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁশের খুঁটি বা বেডের চারপাশে ফ্রেম দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, ভাসমান বেড তৈরির পর উপরিভাগ আবাদ উপযোগী হতে প্রায় ১৫-২০ দিন সময় লাগে। বেড তৈরির পর তাতে সারি করে সরাসরি বীজ বোনা যায়। আবার বল বা বিড়ায় তৈরি করা চারা নির্দিষ্ট দূরত্বে বেডে রোপণ করা যায়। আদা, হলুদ, কচু প্রভৃতি ফসল সরাসরি রোপণ করা যায়। চারা ৫-৬ ইঞ্চি হলে এবং শিকড়ের মাথা বল থেকে বের হলেই (কালো হওয়ার আগেই) বেডে লাগাতে হবে। বিড়া বা ব্যাগের চারা একত্রে বেডে নির্দিষ্ট পরিমাণ গর্ত করে রোপণ করতে হবে। বিড়ার আকার ছোট হলে পার্শ্বে পচা কচুরির আস্তরণ দিতে হবে। নতুন আস্তরণের সঙ্গে ১-২ চা চামচ জৈব সার প্রয়োগ করলে চারা তাড়াতাড়ি বাড়বে। চারা লাগানোর পর সামান্য পানি দিয়ে চারা ও চারার গোড়া ভিজিয়ে দেওয়া আবশ্যক। চারা বেশি লম্বা হলে বাউনি দিতে হবে।
অধিক ফলন পাওয়ার জন্য ভাসমান বেডে ঢ্যাঁড়শ, টমেটো, বেগুন, কলমিশাক ইত্যাদি ফসলের সঙ্গে আন্তঃফসল ও মিশ্র ফসল হিসেবে ঝিঙে, লালশাক, পুঁইশাক, ধনিয়া, ডাঁটা প্রভৃতি চাষ করা যায়। তাছাড়া এ অঞ্চলের পানিকচু দেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত গ্রামের বাজারগুলোয় পাওয়া যায়।
স্থানীয় বাজারের সবজি ব্যবসায়ী শামীম হোসেন বলেন, ‘এখানে উৎপাদিত সব ধরনের সবজি অল্প দামে কিনে নিয়ে বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করি। নৌকা অথবা ট্রলারে করে বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যাওয়ায় যাতায়াত খরচ কম। তাই লাভের পরিমাণ বেশি থাকে।’
এ বিষয়ে নেছারাবাদ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা চপল কৃষ্ণ নাথ বলেন, ‘নেছারাবাদ উপজেলার বিলাঞ্চলে ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদনের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাসমান বেডে সবজি উৎপাদনকারী কৃষকদের আমার দপ্তর থেকে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তাদের বিভিন্ন প্রজাতির সবজির বীজ বিতরণ করা হয়। এ ছাড়া তাদের সুযোগ-সুবিধা আদায়ে উপজেলা প্রশাসন সবসময় খেয়াল রাখছে।’