বাঁওড়ের রংবাহারি পাখি

ছোট ডুবুরি
আশিকুর রহমান সমী
প্রকাশ: ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৩ | আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৪ | ১১:১৬
বাংলাদেশের জলাভূমির মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হলো বাঁওড়। হাওরের সঙ্গে সবাই পরিচিত হলেও, আমরা বাঁওড় সম্পর্কে তেমন অবগত নই– এমনকি বাঁওড়ের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্যও পাওয়া যায় না। দেশের গঙ্গা-নিম্নবর্তী অঞ্চলে ছোট-বড় মিলে, ৮৭টি বাঁওড় রয়েছে। আমাদের দেশের মোট আয়তনের ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর এলাকা এই বাঁওড়ের অন্তর্ভুক্ত। বর্ষায় কানায় কানায় পূর্ণ বাঁওড় শুষ্ক মৌসুমে অনেকটা শুকিয়ে যায়। বর্ষাকালে বিভিন্ন প্রজাতির শাপলাসহ বিভিন্ন ভাসমান উদ্ভিদে পরিপূর্ণ থাকে বাঁওড়। ভাসমান পাতার ফাঁকে জলময়ূর, কলপিপি, ডাহুক, কোড়ার ছোটাছুটি এক অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য।
শীতে পানি কমে গেলে, জলজ উদ্ভিদগুলোর নিচে তৈরি হয় পাখিদের খাদ্যের এক অপূর্ব ভান্ডার। ঝাঁকে ঝাঁকে আসে পাখি। বাঁওড়ের পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো বিভিন্ন প্রজাতির দেশি ও পরিযায়ী বুনোহাঁস। সরালি, বালিহাঁসের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। তবে শীতে যখন পাখি কমে যায়, তখন সরালি আর বালিহাঁস দুটোই বাড়ে। ঝাঁকে ঝাঁকে শত শত সরালি উড়ে বেড়ায় এখানে। তখন আসে পরিযায়ী বুনোহাঁস। যেমন– মৌলবিহাঁস, পিয়াংহাঁস, তিলিহাঁস, ভুতিহাঁসসহ আরও অনেকে। ডুবুরি বাঁওড়ের অন্যতম এক গুরুত্বপূর্ণ পাখি। ঝাঁকে ঝাঁকে ডুবুরি ভেসে বেড়ায় এখানে আর শীতে সংখ্যায় বাড়ে অনেক বেশি। এ ছাড়া বড় পানকৌড়ি উল্লেখযোগ্য এক পাখি। ডাহুক, ঝিল্লি, গুড়গুড়ি, পাতিপান মুরগি, পাতি কুট, চ্যাগা, কোড়া কালেমসহ বিভিন্ন পাখির জলজ উদ্ভিদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত বিচরণ।
শিকারি পাখির মধ্যে আছপ, হ্যারিয়ার ঈগল, বাজ, মধুবাজ, চিল, পেঁচা, মাছ-মুড়াল, শিকরাসহ আরও নানা বৈচিত্র্যের পাখি। খঞ্জনরা লেজ নাড়িয়ে করছে নাচানাচি। সৈকত পাখিরা কমে যাওয়া পানির মধ্যে ভেসে ওঠা জলজ উদ্ভিদ থেকে আপনমনে খেয়ে যায় নিজের খবার। এখানকার পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য এক জায়গাজুড়ে রয়েছে– বিভিন্ন প্রজাতির বগা-বগলা, শামুকখোল, কাস্তেচরার মতো পাখিরা।
জালময়ূরের চোখ জুড়ানো ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়ানো, জল পিপিদের ওড়াউড়ি সব পাখির অপূর্ব এক স্বর্গরাজ্য। বাঁওড়গুলোকে কেন্দ্র করে রয়েছে– অসংখ্য ঘাসবন, যা আশ্রয় দেয় বিভিন্ন প্রজাতির চুটকি, ফুটকি, প্রিনিয়া, ভোমরা ছোটন, বাবুই, মুনিয়া, চটক ও ঘাসপাখিদের। এ ছাড়া হাওর পার্শ্ববর্তী বাগানগুলো এবং মানববসতি ঘুঘু, কোকিল, মালকোহা, কুবো, বাতাসিসহ বিভিন্ন গায়ক পাখির আশ্রয়স্থল।
পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থাপনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি অর্থনীতিতেও বাঁওড়ের জলাশয় পাখিরা রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান; যা সাধারণ মানুষের কাছে অজানা। বাঁওড়ের জলচর পাখিরা পরিবেশের একটি নির্দেশক হিসেবে কাজ করে। একটি জলজ পরিবেশ কতটা ভালো অবস্থায় রয়েছে, তা নির্দেশ করে কী পরিমাণ জলচর পাখি ওই স্থানে রয়েছে এবং কী পরিমাণ জলচর পরিযায়ী পাখির আগমন ঘটেছে ওই এলাকায়। মর্মান্তিক বিষয় হলো বাঁওড়ে নির্বিচারে জলচর পাখি হত্যা। শীত মৌসুম এলে এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিছু ব্যক্তির রসনার শিকার হচ্ছে পাখিরা।
বিশেষ করে পরিযায়ী পাখিসহ বক, বুনোহাঁস, ডাহুক, কালেমের মতো পাখি বেশি ঝুঁকিতে। এদের শিকারে বিষটোপ, এয়ারগান, ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। তবে এখন পাখির ডাক নকল করে বাঁশি বাজিয়ে ও মোবাইল বা সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহারের মাধ্যমে হচ্ছে পাখি শিকার।
বাঁওড়পারের গণমানুষের সঙ্গে আলাপ করলে উঠে আসে আগের মতো আর দেখা যায় না বৈচিত্র্যময় পাখি। আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। স্থানীয় পর্যায়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান আয়োজন করতে হবে, বিশেষ করে যুক্ত করতে হবে তরুণদের। তারাই বেশি ভূমিকা রাখবে পাখিদের সংরক্ষণে।
- বিষয় :
- পাখি
- অতিথি পাখি