ঢাকা শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫

গ্রামের নীল চোখা পাগলিটা

গ্রামের নীল চোখা পাগলিটা

রায়মন নেছা

ইমতিয়াজ আহমেদ

প্রকাশ: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৩১ | আপডেট: ২৫ জানুয়ারি ২০২৫ | ১৫:১৭

রাতে হাড় কাঁপানো শীত নামে গ্রামে। এর সঙ্গে ফিনফিনে বাতাস। সকালের কুয়াশা কেটে সূর্য আলো ছড়াতে বেশ সময় লেগে যায়, তাও ১০টার আগে না। মাঠে মাঠে দিগন্তজোড়া পাকা আমন ধান। কোনো কোনো ক্ষেতে মানে যারা কামলা পেয়েছে, তারা ভ্যানগাড়ি এনে ভিড়িয়েছে কাছিম বিলের তলায় কংকালসার মেঠোপথটার ওপর।

শেষ বেলায় সূর্য যখন ডুবু, তখন রওনা দেবে গাড়িগুলো। একসময় বড়খিলা পশ্চিমপাড়া থেকে টানপাড়া যাওয়ার একমাত্র সড়ক ছিল এটি। এখন পাকা সড়কে মানুষ চলে, মরা সড়কে কৃষক। সকাল সকাল এই পথ ধরেই হাঁটতে লাগলাম। বন্ধু গোলাম মোস্তফার টং দোকানে যেতে হলে এ সড়ক ধরেই যেতে হয়। পথের শেষ প্রান্তে একটা বাঁশঝাড়, সুনসান নীরবতা, এটি মোল্লা বাড়ির কবরস্থান। খুব ঠান্ডা পরিবেশ। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে একটি পুরোনো কবর। এর পাশে দাঁড়িয়ে আছে একজন বয়োবৃদ্ধ নারী। বয়স ৯০ বছরের কম হবে না। রুক্ষ শুষ্ক চুলে তাঁর বহুদিনের জট, চোখে ধূসর নীলাভ মণি, কুচকে গেছে চামড়া, নাকচাবিটা হারিয়েছে কত যুগ আগে কে জানে। কপালের ভাঁজে কালান্তরের গল্প; যা হয়তো তিনি ছাড়া আর কেউ পড়েননি। কবরের সঙ্গে কথা বলছেন রায়মন– কখনও বাবার সঙ্গে, কখনও মায়ের সঙ্গে। রাজ্যের নালিশ তাদের কাছে। গতরাত থেকে তাঁকে কেউ খেতে দেয়নি– এই অভিযোগ করছেন। কবরের পাশে কখনও কাঁদেন, কখনও হাসেন। সারাদিন কোথায় থাকেন রায়মন, কেউ জানে না। হঠাৎ হঠাৎ মা-বাবার কবরের পাশে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়। 

গ্রামে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই নারীর পুরো নাম রায়মন নেছা। গ্রামের সবাই তাঁকে বুজান বলে ডাকেন। ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বড়খিলা গ্রামের মৃত ইসমাইল মিয়ার মেয়ে তিনি। লেখাপড়া করেছেন পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে পঞ্চম শ্রেণি শেষ করতেই বাবা-মা দু’জনই মারা যান। মানুষ হন চাচাদের কাছে। বড় চাচা ধুমধাম করে বিয়ে দেন রায়মনের। সবই ঠিকঠাক চলছিল। এক ছেলে ও মেয়ের জননী হন। তৃতীয় সন্তান প্রসবের পর রায়মন জানতে পারেন তিনি মৃত সন্তান জন্ম দিয়েছেন। সন্তানের মুখ দেখে বিলাপ করতে থাকেন। মানসিক ভারসাম্য হারান। দেখতে দেখতে ৪০ বছর কেটে গেল। বেশ কিছু বছর আগে মারা যান তাঁর ছেলেটি। মেয়েটি বেঁচে থাকলেও নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা তাঁর। মেয়ে ছাড়া পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই রায়মনের।

আরও পড়ুন

×