শিক্ষা
এই পাঠ্যবই পড়ে আমাদের শিশুরা কী শিখবে

ফাইল ছবি
ফাতিহুল কাদির সম্রাট
প্রকাশ: ২৯ জুলাই ২০২৪ | ২১:৪৯ | আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৪ | ২১:৪৯
সম্প্রতি বিভিন্ন পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। তাতে পাঁচটি ভুল শনাক্ত করে সেগুলোর সংশোধনী দেওয়া হয়েছে। তবে শুধু সপ্তম শ্রেণির ‘ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান’ বইটির উপস্থাপনা, ভাষাবিন্যাস, বানান ও তথ্য-উপাত্তের অসংগতি লক্ষণীয়। এই বই পড়ে আমাদের সন্তানেরা কী শিখবে; তাদের মানসপটে বইটি কী ছাপ
রাখবে, তা ভাবতে গিয়ে নিতান্তই অসহায় বোধ করছি।
বইটিতে অধ্যায় আছে ১০টি। এর লেখক ১৪ জন। লেখকদেরই দু’জন বইটি সম্পাদনা করেছেন। লেখক নিজেই সম্পাদক হলে ফল কী হতে পারে, সহজেই অনুমেয়। উপরন্তু প্রত্যেক লেখকের ভাষাভঙ্গি, বানানবোধ, উপস্থাপনা কৌশল আলাদা হবে– এটাই স্বাভাবিক। সম্পাদকের কাজ হলো কাঁচি চালিয়ে সব লেখাকে একটি মানে দাঁড় করানো। কিন্তু বইটিতে সম্পাদনার কোনো ছাপ নেই। একেকটি অধ্যায়ের মান একেক রকম।
বইয়ে দেশি-বিদেশি ব্যক্তির নাম এসেছে প্রাসঙ্গিকভাবে। কিন্তু একই ব্যক্তির নাম একাধিকরূপে লেখা হয়েছে। বিখ্যাত সাংবাদিক সাইমন ড্রিং-এর নামটি লেখা হয়েছে সায়মন ড্রিং, সাইমন ড্রিং ও সাইমন ড্রিংক– এই তিন রূপে। অন্তত দুটি স্থানে ড্রিং হয়েছে ড্রিংক (পৃ. ৭৭ ও ৭৮)। পণ্ডিত রবিশঙ্করের নামটিরও তিনটি রূপ দেখা যায়। ৭৬ পৃষ্ঠায় এই সংগীতগুরুর ছবির নিচে ক্যাপশনে বলা হয়েছে, ‘বিখ্যাত সেতারাবাদক।’ সেতারকে সেতারা লেখার মধ্য দিয়ে যে অজ্ঞতা প্রকাশিত হয়, তা সংশ্লিষ্ট লেখক বা সম্পাদক হয়তো বুঝতেই পারেননি। ব্রিটিশ গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে লেখক ফরাসি জ্ঞান দেখাতে ‘হ্যারিসঁন’ লিখে থাকতে পারেন। আবার ফরাসি বলে অঁদ্রে মালরোর নামে নাসিক্যধ্বনির অকারণ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এডওয়ার্ড কেনেডিকে একবার বলা হয়েছে মার্কিন সিনেটর, আরেক জায়গায় আমেরিকান সিনেটর। আলেক্স কোসিগিনকে বলা হয়েছে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১ সালে রাশিয়া ছিল, না সোভিয়েত ইউনিয়ন? বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, উ থান্টসহ প্রখ্যাত ব্যক্তিদের নামের বানান ও রূপ বিকৃতি দৃষ্টিকটু শুধু নয়, অপরাধও বটে। ইতিহাস অংশে বিভিন্ন শাসকের নামেও রয়েছে ঢালাও বিকৃতি।
তথ্য-উপাত্তের ক্ষেত্রে এমন কিছু ভুল আছে, যা লেখক-সম্পাদকদের দায়িত্বশীলতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। বিপ্লবী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জীবনকাল দেখানো হয়েছে ১৯২১-১৯৩২, তার মানে মাত্র ১১ বছর। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে বৈশ্বিক মিডিয়ায় সর্বপ্রথম রিপোর্ট ছেপেছিলেন সাইমন ড্রিং, ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ, লন্ডনের ‘দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায়। শিরোনাম ছিল– ‘ট্যাঙ্কস ক্রাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’। এ বইতে রিপোর্ট প্রকাশের তারিখ দেখানো হয়েছে ২৯ মার্চ।
এই বইয়ে উইকিপিডিয়া থেকে আহরিত ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনের প্রমাণ আছে। ‘টেকসই উন্নয়ন ও আমাদের ভূমিকা’ শীর্ষক অধ্যায়ে সম্পদ ব্যবহার সম্পর্কিত তিনটি টার্ম যথাক্রমে রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকল এবং এদের সংকেত ব্যবহার করা হয়েছে। রিডিউস-এর বাংলা করা হয়েছে কমানো, রিইউজ-এর পুনরায় ব্যবহার ও রিসাইকল-এর বাংলা করা হয়েছে পুনর্ব্যবহার। পুনরায় ব্যবহার ও পুনর্ব্যবহার-এর অর্থ একই, কিন্তু টার্ম দুটি ভিন্নার্থক। রিইউজ মানে কোনো বস্তুকে ফেলে না দিয়ে আবার ব্যবহার। যেমন– বালতির হাতল ভেঙে যাওয়ার পর সেটিকে ময়লার বিন বা ফুলের টব হিসেবে ব্যবহার করা। আর রিসাইকল অর্থ হলো কোনো পরিত্যক্ত বস্তুকে কাঁচামালে রূপান্তর করে নতুন কোনো প্রডাক্ট তৈরি করা। উইকিপিডিয়া থেকে কাট-পেস্ট করার কারণে আমাদের বাচ্চারা যে ভুল শিখছে, তার দায়িত্ব কে নেবে?
কোনো প্রফেশনাল প্রুফরিডার দ্বারা বইটির প্রুফ সংশোধন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। প্রমিত বানানরীতি বা অভিধানেরও ধার ধারেননি লেখকরা। একই শব্দের দু-তিন রকম বানান প্রয়োগ করা হয়েছে। এমনকি একটি শব্দে একাধিক বানান অসংগতিও লক্ষ্য করা যায়। যেমন– লক্ষণীয় শব্দটি লেখা হয়েছে ‘লক্ষ্যণীয়’। একই লাইনে একটি শব্দের একাধিক বানান খুবই পীড়াদায়ক এবং বিভ্রান্তিকর। নিকট দূরত্বে ‘বাংলা’ ও ‘বাঙলা’ অসংখ্যবার লেখা হয়েছে। অতিপরিচিত শব্দ যেমন– কারণ, ধরন, দেশি, ব্যক্তি, বাধাবিপত্তি, বাঙালি, শ্রেণি, নিয়ন্ত্রণ, সঙ্গে, সঙ্গী, সংগীত, রূপ, আত্ম, মুখস্থ, উদ্যোগ, তৈরি, রঙিন, কৌতূহল প্রভৃতি শব্দের ভুল বানান দৃষ্টিকটু এবং পীড়াদায়ক। অধিকাংশ সমাসবদ্ধ শব্দ বিযুক্তরূপে ব্যবহার করা হয়েছে, যা ব্যাকরণের দিক থেকে শুধু অশুদ্ধ নয়, অর্থবিপত্তিরও কারণ। গঠনগত ত্রুটির কারণে অনেক বাক্যের অর্থ স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি। মুক্তিযুদ্ধে দেশের সামগ্রিক বিপর্যস্ত অবস্থা বোঝাতে একখানে লেখা হয়েছে– ‘সকল কিছুই ভেঙে গিয়েছিল।’ লেখকরা ‘ভেঙে যাওয়া’ আর ‘ভেঙে পড়া’র মানে আলাদা করতে পারেননি। কিন্তু সম্পাদকরা কী করেছেন?
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিষয়েও লেখক-সম্পাদকরা বিশেষ মনোযোগ দেননি। একটি অধ্যায়ের নাম ‘হাজার বছরের পথপরিক্রমায় বাংলা অঞ্চলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’; কিন্তু এখানে বঙ্গবন্ধুর অবদান ও কৃতিত্ব অস্পষ্ট। নেই বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিক বর্ণনাও। স্বাধীনতাবিরোধীদের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, ২৫ মার্চ কালরাতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ধরা দিয়েছিলেন। এ বইয়ে এই ঘৃণ্য কথারই প্রতিধ্বনি করা হয়েছে। ৮৩ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ২৫ মার্চ মধ্যরাতে তিনি নিজ বাড়িতে গ্রেপ্তার বরণ করেছিলেন। ‘নিজ বাড়িতে গ্রেপ্তার বরণ’ শুনলে মনে হবে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের ডেকে এনে নিজেকে তাদের হাওলায় দিয়েছিলেন। লেখকরা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে অবমাননা করতেও কসুর করেননি। তারা সজ্ঞানে এর অনন্যতা ও মাহাত্ম্যকে অস্বীকার করে ভাষণটিকে সাধারণীকরণ করেছেন। ৭৩ পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত এক ভাষণে বলেন...।’ এ কথা শুনে মনে হবে, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু অনেক ভাষণ দিয়েছিলেন; রেসকোর্স ময়দানের ভাষণ এগুলোর মধ্যে একটি। অথবা এ-ও মনে হতে পারে, ৭ মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অনেক ভাষণের মধ্যে সাধারণ একটি ভাষণ মাত্র। অথচ বিশ্বের ইতিহাসে এটি একটি তুলনারহিত ভাষণ; একটি জাতির আত্মনির্মাণের দিকনির্দেশনা। ৬১ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বর্ণনায় শুধু ১৫ আগস্ট উল্লেখ করা হয়েছে, সাল অনুপস্থিত।
পুরো বইতে স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানা খুঁজে পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশকে বারবার অবিভক্ত বাংলার ক্ষুদ্রাংশ বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা লক্ষ্যযোগ্য। পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশকে বাংলার পূর্ব অংশ বলার কারণ কী? অন্তত একটি লাইন পড়ে মনে হতে পারে, কোনো বিদেশি লেখক বইটি লিখেছেন। প্রাচীন বাংলার রাজধানী বিক্রমপুর প্রসঙ্গে বলা হয়েছে– ‘বর্তমান রাজধানীটি খুঁজে পাওয়া যাবে বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলায়।’
পাঠ্যবইয়ের কারণে সরকারকেও বারবার সমালোচনা সইতে হয়েছে; হতে হয়েছে বিব্রত। সরকার যাদের ওপর কারিকুলাম ও পাঠ্যবই প্রণয়নের দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা কি তাদের দায়িত্ব বিষয়ে সচেতন? তাদের অধিকার নেই আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছেলেখেলা করার।
ফাতিহুল কাদির সম্রাট: অধ্যক্ষ, বাঞ্ছারামপুর সরকারি কলেজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
- বিষয় :
- শিক্ষাব্যবস্থা