শর্ষে থেকে ভূত তাড়ান আগে

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: ০৫ অক্টোবর ২০১৯ | ১৪:৫৫
অতি সম্প্রতি শুধু দেশে নয়, বহির্জগতে বাংলাদেশকে নিয়ে যে বিষয়টি গভীর কৌতূহল সৃষ্টি করেছে তা হলো, বঙ্গবন্ধুকন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার অভূতপূর্ব সুশাসন প্রতিষ্ঠার দুরূহ অভিযাত্রা। এর মৌলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অন্যের প্রতি অঙ্গুলি বা দৃষ্টি প্রদর্শন না করে আত্মসমালোচনা এবং নিগূঢ় আত্মশুদ্ধিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নিজ দলীয় বাসভূম থেকেই দুর্নীতি নির্মূলে অপ্রতিরোধ্য অভিযান পরিচালনা। অসীম সাহসিকতায় বঙ্গবন্ধুকন্যার এই ব্রত বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের সব নাগরিককে করেছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় ভাবোচ্ছ্বাস উদ্দীপ্ত। অকুণ্ঠ সমর্থন ও আকাশচুম্বী প্রশংসায় নেত্রীকে করেছেন সম্ভাষিত, নতুন পালকে অবিনাশী মুকুটে সুসজ্জিত। হয়েছেন নন্দিত ও বরেণ্য বিশ্বের বিস্মিত সফল রাষ্ট্রনায়ক। জাতি শুধু বুকভরে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে না, টেকসই স্থিতিশীল উন্নয়ন সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে বিশুদ্ধ অনুপ্রেরণা ও প্রণোদনায় হয়েছে ব্যাপক স্পন্দিত।
উত্তম বা অসৎ চরিত্রের বিভাজন ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মযজ্ঞকে গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্নীতি এমন একটি অসৎ চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ, যা পুরো জাতির উন্নতি-সমৃদ্ধিকে বিপর্যস্ত করতে পারে। আভিধানিক অর্থে দুর্নীতি হলো নীতিবিরুদ্ধ আচরণ বা নীতিহীনতা। তবে সামগ্রিক প্রচলিত বিবেচনায় আর্থিক দুর্নীতিকেই দুর্নীতির প্রধান অনুষঙ্গ হিসেবে ধরা হয়।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪, ধারা ২ (ঙ) এবং তফসিলে দণ্ডবিধির ২৯ ধারামতে যেসব অপরাধ উল্লেখ করা হয়েছে, মূলত এসব অপরাধ অর্থ বা সম্পদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। মোদ্দা কথা, অর্থনৈতিক অপরাধকেই দুর্নীতি ও এসব অপরাধে দায়ী ব্যক্তিরাই দুর্নীতিবাজ হিসেবে পরিচিতি পাবে। এটি অনস্বীকার্য যে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্ব আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। উন্নত বা উন্নয়নশীল, ইসলামী প্রজাতন্ত্র বা গণপ্রজাতন্ত্র, প্রাচ্য বা পাশ্চাত্য সব দেশেই কমবেশি দুর্নীতির প্রভাব রয়েছে। যেসব কারণে মানুষ দুর্নীতি করে থাকে, তার মূলে আছে অর্থ, সম্পদ, ক্ষমতা, আধিপত্য, ভোগবিলাস ইত্যাদির প্রাসঙ্গিকতা। অর্থনৈতিক বৈষম্য বা ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থ ও সম্পদের উপার্জন, বিতরণ, ভোগ ইত্যাদি দুর্নীতির মাত্রা ও প্রকৃতিকে নানাভাবেই উপস্থাপন করে।
অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনায় অপরূপ দীক্ষিত জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশপ্রেমের অত্যুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে দুর্নীতি উচ্ছেদে তার এই যুগান্তকারী উদ্যোগের জন্য শুধু গণমানুষের আশীর্বাদপুষ্ট হচ্ছেন না; মহান স্রষ্টারও অনুপম অনুগ্রহপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
বিশিষ্ট সমাজ-অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুন্নার মিরডলের মতে, 'সংস্কার, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ইত্যাদি কোনো কিছুতেই আমার কোনো আস্থা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্নীতি দূরীকরণের কোনো চেষ্টা না হচ্ছে।' প্রসঙ্গত, তার মতানুসারে ভারতের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে দুর্নীতিকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার প্রবণতা কত যে ভয়ঙ্কর, তা রাষ্ট্র পরিচালকদের অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে এবং এসব দেশে দুর্নীতি দমনই হলো প্রধানতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। উচ্চ মধ্যবিত্ত বা বিত্তশালী ক্ষমতাবান ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়া এবং এর বিস্তৃতি ঘটানো খুবই সহজ, দরিদ্র শ্রেণির পক্ষে নয়। উদাহরণস্বরূপ ১৯৮৫ সালের ২৫ জুন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড পলিসি কর্তৃক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৯৮৩-৮৪ সালে কালো টাকার পরিমাণ ছিল ৩১ হাজার ৫৮৪ কোটি থেকে ৩৭ হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা অর্থাৎ তা মূল অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ১৮ থেকে ২১ শতাংশ। রিপোর্ট অনুসারে ১৯৭৫-৭৬ সালে কর আদায়ের আওতার বাইরে ছিল প্রায় ৭০ থেকে ৭৪ শতাংশ।
ইতিপূর্বে প্রকাশিত কিছু নিবন্ধে লিখেছিলাম, ২০০২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ ক্রমান্বয়ে চার বছর দেশ বিশ্বের দুর্নীতির শীর্ষ অবস্থানে ছিল। দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ক্ষেত্রে অবৈধ সামরিক শক্তি সমর্থিত কথিত গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে বিশ্বে বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল প্রায় পাঁচবার। কিন্তু অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক চিত্র হচ্ছে, ২০০৯ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনা দক্ষ সরকার পরিচালনায় দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং সর্বক্ষেত্রে সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছিলেন বলেই ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে তিনি বিশ্বের ১৭৩টি দেশের সরকারপ্রধানদের মধ্যে সততার জন্য শীর্ষ পাঁচটি আসনের মধ্যে নিজেকে তৃতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত করতে পেরেছিলেন।
আমরা অবগত আছি যে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে জাতিকে আত্মনির্ভরশীল করার লক্ষ্যে নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন প্রক্রিয়ার সূচনা করেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী)। স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে মানুষের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন; যার প্রধান লক্ষ্য ছিল দুর্নীতি দমন; ক্ষেতে-খামারে ও কলকারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধি; জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই লক্ষ্যে দ্রুত অগ্রগতি সাধিত করার মানসে ১৯৭৫ সালের ৬ জুন বঙ্গবন্ধু সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী মহলকে ঐক্যবদ্ধ করে এক মঞ্চ তৈরি করেন, যার নাম দেন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ। বঙ্গবন্ধু এই দলের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, 'শর্ষের মধ্যে ভূত' থাকলে দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া খুবই কঠিন। অর্থলোভী, বিত্ত ও ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির মাধ্যমে ইতিমধ্যেই যেভাবে দেশের অর্থনীতি ও সামগ্রিক উন্নয়নকে চ্যালেঞ্জ করছে, তাদের কঠোর হস্তে আইনের আওতায় এনে দমন করা না গেলে এই অবস্থা আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে- প্রধানমন্ত্রী যথাসময়ে এর যথার্থতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, 'গরীব-দুঃখীর সুখেই স্বাধীনতার সার্থকতা।' তিনি আরও বলেছেন, 'জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি বা আপনারা সবাই মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটা নিরপরাধ লোকের ওপরও যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে।'
উল্লেখ্য, ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেন- "এবার আমি আপনাদের সাহায্য চাই। আপনারা একবার আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞা করুন, 'আমরা দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থাকব।' প্রতিজ্ঞা করুন, 'আমরা দুর্নীতিবাজদের খতম করব।' প্রতিজ্ঞা করুন, 'আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষকে ভালোবাসবো, দেশের মাটিকে ভালোবাসবো।" বঙ্গবন্ধু বলেন, 'যারা দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, রাতের অন্ধকারে যারা মানুষ হত্যা করে, থানা আক্রমণ করে, অস্ত্র নিয়ে আপনাদের মোকাবেলা করে, বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের উৎখাত করুন।'
প্রণিধানযোগ্য যে বিষয়টি সবসময় স্মরণে রাখতে হবে, দুর্নীতি দমনের নামে নিরীহ জনগণের মাঝে যেন আতঙ্ক সৃষ্টি না হয়। বেনামে বা ছদ্মনামে কথিত অভিযোগকারীর অভিযোগ আমলে নিয়ে অনৈতিক আর্থিক যোগসাজশ বা অবৈধ সুযোগের লোভে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বা ব্যক্তিস্বার্থে নিরীহ ও সৎ ব্যক্তিদের হয়রানি করার অপচেষ্টা থেকে বিরত থাকতে হবে। অভিযোগকারীর যথার্থ নাম, ঠিকানা, পরিচয় ইত্যাদি নিশ্চিত হয়ে যে কোনো তদন্ত কার্যক্রম অবশ্যই সমর্থনযোগ্য। এই শর্ত অবশ্যই যুক্ত করতে হবে যে, অভিযোগকারীর অভিযোগ যদি বস্তুনিষ্ঠ, নিরপেক্ষ, দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সমন্বয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে মিথ্যা প্রমাণ হয়, তাহলে অভিযোগকারীকেও কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।
কথিত মিথ্যা অভিযোগের তদন্ত আত্মসম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন ব্যক্তিবর্গের সমাজে সম্মানহানির ঘটনায় যাতে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, অভিমান, অসহায়ত্ব ও হতাশা তাদের আত্মহননে প্ররোচনা বা বিপথগামী না করে, সেদিকে অবশ্যই কঠিন মনোযোগ নিবিষ্ট করতে হবে। সঠিক অর্থে যথার্থ পন্থা অবলম্বনে দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতেই হবে। না হলে বাংলার আগামী দিনের ইতিহাসের অধ্যায়ে আমরা দায়বদ্ধ হয়ে থাকব। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এই অভিযানের যথাযথ তত্ত্বাবধান, পুনঃযাচাই ও মূল্যায়নের জন্য নৈতিকতার মাপকাঠিতে অনন্য উচ্চতায় দেশে যারা খ্যাতিমান হয়েছেন, তাদের সম্পৃক্ত করা হলে দুর্নীতি নির্মূলের দৃশ্যমান বাস্তবায়ন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা রাখবে- এটিই জাতির প্রত্যাশা।
শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
- বিষয় :
- দুর্নীতি
- ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী