ঢাকা রবিবার, ০৬ জুলাই ২০২৫

বিমূঢ়, বিস্মিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ

বিমূঢ়, বিস্মিত ও যন্ত্রণাবিদ্ধ

আয়শা খানম

প্রকাশ: ২৩ ডিসেম্বর ২০১৯ | ১৩:৫৫

পৃথিবীর খুব কম দেশেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় আছে। কিন্তু বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র প্রয়োজন ছিল এবং আছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক একটি পৃথক রাষ্ট্রীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের। এই মন্ত্রণালয়ের মূল কাজ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সব দলিলপত্র, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তথা মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল সব ঘটনাপঞ্জি, ইতিহাস, সবকিছু সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা। এই ইতিহাস, এই ঘটনাপঞ্জি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ভবিষ্যৎ বংশধররা পড়বে, জানবে, সাহস নেবে, শক্তি নেবে এবং শিক্ষা নেবে। এর গুরুত্ব অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ের।

সাম্প্রতিককালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু কর্মকাণ্ড আমরা কয়েক বছর ধরে পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব হলেন মিথ্যা মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে এবং তিনি চাকরি স্থায়ীও করে নিলেন।

এ ছাড়া নানা ধরনের অপকীর্তি-দুর্নীতি নিত্যদিনের ঘটনা। সবকিছু মেনে নিয়ে সহ্য করলেও সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটল, সেটা মেনে নেওয়া খুবই কঠিন। বিষয়টি সবাই ইতোমধ্যে বিস্তারিতভাবে জেনেছেন। একাত্তরের রাজাকারের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই তালিকায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর নাম আছে। আজকের যুগে এই একুশ শতকে বন্দুক, অস্ত্র এসব নিয়ে যুদ্ধ হবে না। যুদ্ধ হবে আদর্শগত। আর সেই যুদ্ধ চলছে বাংলাদেশে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, এই কথাটা আমরা বলি। পঁচাত্তরের ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হয়, সেটা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রামের যাত্রাকে পেছনের দিকে ঠেলার চেষ্টা করে। যারা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল, সমগ্র বিবেকী বাঙালি জাতি তাদের কোনোদিন ক্ষমা করেনি, করবে না।

দুঃখের বিষয়, মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল, শক্তি, ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠানের (যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শব্দটিকে সর্বক্ষণ পণ্যের মতো ব্যবহার করে) পক্ষ থেকে স্বাধীনতার রজতজয়ন্তীর এক বছর আগে যে কাজটি করা হলো, তা যেন রজতজয়ন্তীর প্রচ্ছদ তৈরি করা হলো। প্রচ্ছদের মূল চিত্র হচ্ছে স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, অসাম্প্রদায়িক চেতনাবিরোধী শক্তি আদর্শগতভাবে শক্তিশালী হচ্ছে এবং আদর্শিক সংগ্রামে তারা জয়ী হচ্ছে।

প্রতি বছর বিজয় দিবসের সময়ে একটি আলোচনা আমরা করি, যে চেতনায় মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল (?) এবং কোন চেতনায় হয়েছিল, তা নিয়ে আমরা আমাদের নিজস্ব মনের মাধুরী মিশিয়ে অনেক কথা বলি। বারবার মনে প্রশ্নটা আসে, আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বারবার প্রশ্নটা উঠে আসে- আমরা কি সেই আদর্শিক চেতনা থেকে দূরে সরে যাচ্ছি?

রাষ্ট্র পরিচালনা করা এক কঠিন পরিস্থিতি- বিপক্ষ-বিরুদ্ধ রাজনৈতিক শক্তি, অপশক্তি তাদের মোকাবিলা করে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নিয়ে আসার যে ব্রত নিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৮১ সাল থেকে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা-ভালোবাসা রেখে বলতে চাই- ঠান্ডা মাথায় আমাদের বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা করা প্রয়োজন। অবশ্য আমি এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করি এবং জানি যে, আজকের বিশ্ববাস্তবতায় নানা ধরনের রাজনৈতিক শক্তি, লবি ও ক্ষমতার সঙ্গে এক ধরনের যুদ্ধ করে নিজেদের টিকিয়ে রেখেই রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হয়, চলতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে হাতে-পাওয়া বই ম্যাকিয়াভেলির 'দ্য প্রিন্স' পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এসব কথার অবতারণা আমি আর করতে চাই না। প্রধানমন্ত্রী যখন প্রথম ১৯৮১ সালে এসে তার যাত্রা শুরু করলেন, তখন ঢাকায় ইডেন হোটেলে তার সঙ্গে আমাদের দেখা ও সাক্ষাৎ হলো। সেই সময়ে প্রকাশিত 'সচিত্র সন্ধানী' পত্রিকার লেখক গাজী শাহাব উদ্দিন লিখলেন অসাধারণ এক প্রবন্ধ 'আত্মজার অন্বেষা'। এই অন্বেষায় তিনি এক বিশেষ জায়গায় অবস্থান করছেন। দেশকেও এক বিশেষ জায়গায় নিয়ে গেছেন। সমগ্র দেশবাসীর অকুণ্ঠ সমর্থন পাচ্ছেন। এ ধরনের প্রভূত আন্তরিক সমর্থন খুব কম রাজনৈতিক নেতার জীবনে ঘটে।

শেখ হাসিনা জানেন, গরমে কোন চাদর, শীতে কোন কাঁথা এবং কেমন হবে তার বুনন। জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্রাফটিং, সেই বয়নশিল্পের শিক্ষা তিনি অর্জন করেছেন। আশা করি, এই আবেগের কথা তিনি বুঝবেন সঠিকভাবে। আমি সবসময়ই আশা ও বিশ্বাস করি, তিনি তার এই অসাধারণ ঐতিহাসিক সুযোগ বিপুলভাবে কাজে লাগাতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়- আমাদের অনেকেরই হয়েছে সেই অবস্থা। তাই মাঝেমধ্যে নানা ঘটনায় অনেক বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি।

পদ্মা সেতুর একেকটি স্প্যান যখন যুক্ত হয়, আমাদের বুকের ভেতর একটি নতুন স্পন্দন তৈরি হয়। অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য কানেক্টিভিটির কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি একটি চিন্তাও আমার মনে সাম্প্রতিক সময়ে আসে- কী সওদা নিয়ে আমরা ওই পারে যাব এবং ওপার থেকে কী সওদা এপারে নিয়ে আসব? এটাও পরিস্কার হওয়া দরকার। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপনের মুহূর্তে যে ঘটনাটি ঘটল, তা আমাকে অত্যন্ত দুঃখিত, স্তম্ভিত ও উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধে ও চেতনায় শিক্ষা, সংস্কৃতি, জীবনবোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে জাতীয় সামাজিক বিকাশের জন্য কতটুকু একনিষ্ঠ অব্যাহত সুনির্দিষ্ট প্রচেষ্টা চলছে, এই বিষয়টিও সাম্প্রতিক সময়ে আলোচনা ও উদ্বেগের বিষয়।

বর্তমান সরকারের তথা বাঙালি জাতি এবং রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক একটি পদক্ষেপ হচ্ছে- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। সেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর রাজাকারের তালিকায় নাম। এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে ধরনের ব্যাখ্যা-বক্তব্য এলো, তা আরও উদ্বেগজনক ও দুঃখজনক। মনে হয়েছে, এই তালিকাটি যেন কোনো উৎসবের বাজারের চেকলিস্ট। ঈদ বা পূজার বাজারের প্রস্তুতি। সেখানে কিছু ভুলত্রুটি হয়েছে। অনেক উদ্ভট যুক্তিও সেখানে দেখানো হয়েছে। কী বিস্ময়কর বাংলাদেশ!

ঘটনার পর দেখলাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শেকস্‌পিয়রের মেঠো মানুষেরা- পায়ে জুতা-স্যান্ডেল নেই, লুঙ্গিপরা, গায়ে চাদর পেঁচিয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছেন বিমূঢ় হয়ে। এটাই মনে হয় তাদের বক্তব্য ছিল। অতি সাধারণ তারা, চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন, নীরবে। বরিশালের তপন কুমার চক্রবর্তী এবং তার মাতার নামও রাজাকারের তালিকায়। অপমানের সীমা থাকা উচিত। আমরা প্রায়ই বলে থাকি, 'আপনারা এই দেশকে নিজের দেশ মনে করে থাকবেন, কেন আপনারা পর ভাবেন, কেন চলে যাবেন'- এসব আশ্বাসবাণী। অন্যদিকে আমরা এমনভাবে আঘাত করি, যেন মৃত্যু চেয়ে চলে যাওয়াই শ্রেয়। বোন মনীষা চক্রবর্তীকে দেখছি- অপমানের আঘাতের ছাপ তার মুখে। আসলে মনীষার চেহারা দেখে আমার কিছুদিন আগে 'সুবোধে'র গ্রাফিত্তির কথা মনে হলো। গ্রাফিত্তিতে সুবোধ বলেছিল-'চলে যা, এখন দুঃসময়'। তা কি অতিকথন ছিল?

আমি পরিস্কার ও সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় আমাদের রাষ্ট্রের পরম গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিরা এ ধরনের দায়িত্বহীন কাজ করার অধিকার রাখতে পারেন না। তাদের কোনো অধিকার নেই সমগ্র বাঙালি জাতির অহঙ্কার মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে ছলচাতুরী করার। অবিলম্বে এই মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল, তা জানানোর দাবি জানাচ্ছি।

আমি ৬০ কোটি টাকার পেনড্রাইভের আলোচনায় যাচ্ছি না। আমাদের রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় ধরে একটি শব্দ চালু আছে 'ষড়যন্ত্র' এবং এই ঘটনার পেছনে 'ষড়যন্ত্র' আবিস্কার করা হয়েছে। আমার প্রশ্ন- এক যুগের অধিক সময় ধরে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি রাষ্ট্র পরিচালনায় থাকার পরও কেন এসব 'ষড়যন্ত্র' এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি কালকেউটে সাপের মতো ঘাপটি মেরে আছে?

এর কিছুদিন আগে বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে পাঠ্যসূচি গ্রহণ করা হলো। তাতে আরও একবার প্রমাণ হলো, আমরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে আমাদের বিরুদ্ধশক্তিকে শক্তিশালী করছি। এসব দৃশ্যপট দেখে মনে হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রচলিত সেই প্রবাদের কথা- 'তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে।' সারা উপমহাদেশ ও বিশ্বের অনেক অঞ্চলের অভিজ্ঞতা আমাদের এই সাবধানবাণী স্মরণ করিয়ে দেয়।

আমার মনে হয়, গত ৩-৪ দিন আগের ঘটনাটি তারই সঙ্গে যুক্ত। তালিকাটি প্রকাশের রাতে একজন সাধারণ নাগরিক বললেন, আমরা অনেকবার মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ভূত দেখেছি। এই ভূত আমাদের তাড়াতে হবে। আইনগত সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন এই বিষয়ে।

কোনো ব্যক্তি বা একটি রাষ্ট্রের অনেক ধরনের সম্পদ থাকে- বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সম্পদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা (যার প্রতিফলন ঘটেছিল বাহাত্তরের সংবিধানে)। সহস্রমুখী সংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমাদের এই সম্পদ রক্ষা করতে হবে। এই প্রশ্নে কেউ ছাড় দেবে না। আবার আমি এটি লক্ষ্য করলাম। কী বিচিত্র এই বাংলাদেশ!

সভাপতি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ


আরও পড়ুন

×