কচ্ছপ বাহিনী যেভাবে বাঁচাচ্ছে দ্বীপের জীববৈচিত্র্য

দৈত্যাকার কচ্ছপ- সংগৃহীত ছবি
মো. মাহমুদুল হাসান
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৪ | ১৭:২৫ | আপডেট: ০৫ মার্চ ২০২৪ | ১৮:০৮
কচ্ছপ বিশ্বের অনেক স্থানে পাওয়া যায়। এটি সরীসৃপ প্রাণী। একেক স্থানে একেক উপায়ে ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে কচ্ছপ। গ্যালাগোস দ্বীপে প্রাণীগুলো বুলডোজার হিসেবে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে। প্রত্যন্ত দ্বীপে বিশালাকার কচ্ছপ অ্যালবাট্রসের চলার পথ পরিষ্কার করে জীববৈচিত্র রক্ষা করে।
মানুষের বসতি স্থাপনের আগে এস্পানোলায় প্রায় ৮০০০ কচ্ছপ ছিল। ১৮৮০-র দশকে জলদস্যুরা দ্বীপটি দখল করেছিল। এরপর তারা মাংসের চাহিদা পূরণে তিমি, কচ্ছপ শিকার শুরু করে। নাবিকেরা সেখানে ছাগল রেখে যায়। এসব বন্য ছাগল বহুগুণ বেড়ে সেখানকার গাছপালা খেয়ে শেষ করতে থাকে।
এরপর ১৯৭০-এর দশকে কচ্ছপের আদি আবাসস্থলের বেশিরভাগই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ওই সময় এস্পানোলায় ধ্বংসস্তুপ থেকে বাঁচে মাত্র ১৪টি কচ্ছপ। এর মধ্যে ১২টি স্ত্রী প্রজাতির, দুটি পুরুষ। পরে সেগুলোকে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৪ সালের মধ্যে সান্তা ক্রুজের ডারউইন রিসার্চ স্টেশনে আনা হয়েছিল।
প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। অসংখ্য দ্বীপ নিয়ে গঠিত গ্যালাপাগোসে মাত্র চারটি জনবসতি রয়েছে। সেখানেই ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনিসহ বাস করছেন ডিয়েগো। পরিবারটি অন্যতম, যারা দ্বীপটির কচ্ছপের বিলুপ্তি রক্ষায় কাজ করছে। ধ্বংসস্তুপ থেকে জীবিত কচ্ছপগুলোকে ডিয়েগোর আবিষ্কার করা সান দিয়েগো চিড়িয়াখানায় স্থানান্তর করা হয়। ২০২০ সালে অবসর নিয়ে জন্মস্থানে আসার আগে সেখানে শতাধিক কাছিম জন্ম নেয়।
ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে এবং ভার্জিনিয়া টেকের সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী এলিজাবেথ হান্টার বলেছেন, কচ্ছপের গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্র বানানোর স্বভাব রয়েছে। তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে কাছিমের বাস্তুশাস্ত্র অধ্যয়ন করেছেন। তিনি বলেন, কচ্ছপরা তৃণভোজী। এরা হারিয়ে গেলে সেখানে গাছ বেড়ে গিয়ে প্রাণীদের জীবনও হুমকিতে পড়ে।
তিনি বলেন, ১৮৩৫ সালে চার্লস ডারউইন যখন গ্যালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করেন। তখন তিনি সান ক্রিস্টোবালের একটি আগ্নেয়গিরির পাশে উচ্চভূমি থেকে নিম্নভূমিতে চলার একটি পথ দেখেন। এটা কচ্ছপের চলাফেরার কারণে ঘটে। এস্পানোলার কচ্ছপগুলো বিপন্ন অ্যালবাট্রসগুলোর চলাফেরার পথ পরিষ্কার করে। এতে অ্যালবাট্রসগুলো প্রায় একচেটিয়াভাবে বংশবৃদ্ধি করে।
জীববিজ্ঞানী হান্টার আরও বলেন, অ্যালবাট্রসের ডানা ২ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। উড়ার জন্য দৌঁড় শুরু করলে পাখিগুলোর বড় খোলা জায়গার দরকার হয়। আর এই জায়গা তৈরি হয়; যখন কচ্ছপগুলোর দলবেধে চলাফেরা করে। এ সময় ছোট তৃণগুলো সরে পাখির উঠানামার ল্যান্ডিংস্টেশন তৈরি হয়। তারা না থাকলে অ্যালবাট্রস বিলুপ্ত হতে পারে।
হান্টার আরও বলেন, কচ্ছপদের দৈনন্দিন জীবন-যাপন দ্বীপের প্রাকৃতিক চক্রকে সহায়তা করে। একটি কচ্ছপ বছরে শত শত কিলোগ্রাম গাছপালা খেতে পারে। না খেলে তা পদদলিত করে। এতে ছোট উদ্ভিদগুলো কম গজায়। গতিশীল দৈত্যাকার কচ্ছপ মূলত একটি বুলডোজার। এটি তার পথের সবকিছুকে সরিয়ে দিয়ে পথ পরিষ্কার করে। এর মাধ্যমে জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়।
৫০ বছরের প্রজনন কর্মসূচির মাধ্যমে এস্পানোলার কচ্ছপের সংখ্যা এখন ৩০০০। এর ফলে সেখানে দেশীয় ঘাস এবং ক্যাকটি বাড়ছে। ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কাঠের গাছপালা ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে, খোলা সাভানা তৃণভূমি ফিরে আসছে। আর এসব ঘটছে কচ্ছপ বাহিনীর কারণেই।
স্থল প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও কচ্ছপের পানির প্রতি অসাধারণ ভালবাসা রয়েছে। একসঙ্গে তারা দুই ডজন বা তারও বেশি কর্দমাক্ত পুকুরে ভিজতে পারে। দুই পা দিয়ে তারা পানি প্যাডেলিং করে। শুধুমাত্র তাদের মাথা এবং শরীরের খোলের একটু শৈবালের উপরে দেখা যায়।
শরীর ঠাণ্ডা করার জন্য কচ্ছপ পুকুরে নামার সময় ডাঙ্গার কাদা পানিতে নিয়ে যায়। এটি জলে মলত্যাগ করে, যা পানিতে সার হিসেবে যোগ হয়। এভাবে বছরে এক টন মাটি বাস্তুচ্যুত হয়। কচ্ছপ অক্সিজেনের স্তর পরিবর্তন করে। উদ্ভিদ এবং পোকামাকড়ের জন্য একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ জলজ পরিবেশ তৈরি করে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, কচ্ছপরাও ‘অদ্ভুত বীজ বিচ্ছুরণকারী’। এরা দুই সপ্তাহে ১০ কিলোমিটার হাঁটতে পারে। পথে তারা মলের মাধ্যমে হাজারো বীজ ছড়িয়ে দেয়। বীজগুলো কচ্ছপের পেটে একমাস অঙ্করোদগম ক্ষমতাসম্পন্ন থাকে। মূল উদ্ভিদ থেকে এগুলো অনেক দূরে যায়। এটি দ্বীপে টমেটোর মতো স্থানীয় উদ্ভিদের অঙ্কুরোদগমের সম্ভাবনাকে উন্নত করবে বলে মনে করা হয়।
কচ্ছপ বিশ্বের অনেক জায়গায় পাওয়া যায়। ভিন্নস্থানে ভিন্ন উপায়ে ইকোসিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করে। উত্তর আমেরিকায় গোফার কচ্ছপরা ১২ মিটার বা ৩৯ ফুট পর্যন্ত লম্বা গর্ত খুঁড়ে যেখানে সাড়ে ৩০০ কচ্ছপ বাস করতে পারে। অন্যান্য প্রজাতির মধ্যে বরোজিং পেঁচা, ফ্লোরিডা মাউস এবং ইস্টার্ন ইন্ডিগো সাপ রয়েছে।
ভারত মহাসাগরের দ্বীপগুলিতেও কচ্ছপরা বনায়নের অংশীদার হয়েছে। মরিশাসের প্রধান দ্বীপে অ্যালডাব্রা অ্যাটল থেকে দৈত্যাকার দুটি বিলুপ্তপ্রায় কচ্ছপ আনা হয়েছে। এরা ক্ষতিকর ঘাস খেয়ে দেশীয় গাছপালা বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
রিজার্ভ পরিচালনাকারী সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী ক্রিস্টিন গ্রিফিথস বলেছেন, ‘কচ্ছপগুলো স্বাভাবিকভাবেই খোলা জায়গা তৈরি করে। আমরা চাই, এরা আগাছা কম রাখুক। তাতে রোপণ করা গাছগুলো বড় হতে পারে। ছোট ঘাসের এলাকা তৈরি হয়।’ তিনি বলেন, এটি ঘাসকে তার রূপ পরিবর্তন করতে বাধ্য করে।
মরিশাস উপকূলের দুটি দ্বীপে কাছিমগুলোও বন সম্প্রসারণে সহায়তা করছে। জীববিজ্ঞানী গ্রিফিথস বলেছেন, মধ্যাকর্ষণ এবং বায়ু বীজগুলোকে নিচে নিয়ে যেতে পারে। কিন্তু কচ্ছপরা উপরের দিকে নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘রাউন্ড আইল্যান্ডে এখন এমন তৃণ জন্মেছে, যা আমরা কখনও দেখিনি।’ কচ্ছপরা সত্যিই পরিবেশের প্রকৌশলী করছে, যোগ করেন তিনি।
দৈত্যাকার কচ্ছপরা পতিত আবলুস ফলগুলো খেয়ে পেটে বীজ বোঝাই করে। এরপর তারা সূর্যতাপের প্রয়োজনে বনের বাইরে গেলে সেখানে বীজগুলো ছড়িয়ে দেয়। গ্রিফিথস বলেছেন, হঠাৎ আপনি অঙ্কুরিত আবলুস চারাগুলোর খুব ঘন প্যাচগুলো দেখতে পাবেন। এটি বেশ চিত্তাকর্ষক।
দ্বীপগুলোতে দৈত্যাকার কচ্ছপগুলো পুনরুদ্ধার করার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি ও উদ্ভিদ সম্প্রদায় ভালো ফল পেতে শুরু করেছে। শতাব্দী না হলেও এই জাতীয় প্রকল্পগুলোর সাফল্য কয়েক দশকে পরিমাপ করা হয়। এস্পানোলার গবেষকরা কচ্ছপের মাধ্যমে ঘটা পরিবর্তন দেখতে এক দশক কেটে যেতে পারে। গ্যালাপাগোস কচ্ছপদের প্রজনন বয়সে পৌঁছাতে ২০ বছর বা তারও বেশি সময় লাগতে পারে।
অতি পরিচিত এই সরীসৃপ প্রাণী জল ও স্থল উভয় স্থানেই বসবাস করে। শক্ত খোলসের এই প্রাণীর প্রায় ৩০০ প্রজাতি রয়েছে। বাংলাদেশে রয়েছে ২০ প্রজাতির কচ্ছপ। এর মধ্যে কিছু প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারে (আইইউসিএন) সামুদ্রিক কচ্ছপের জীববৈচিত্র হুমকির পাঁচ কারণ উল্লেখ করা হয়- জালে জড়িয়ে, আবাসস্থল ধ্বংস ও খাদ্যশৃঙ্খলে পরিবর্তনের কারণেও মারা যাচ্ছে অনেক কচ্ছপ; সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিম খাওয়া, মাংস খাওয়া ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের পণ্য তৈরি করা; ডিম পাড়ার জন্য সংরক্ষিত স্থানে পর্যটকদের বেশি আনাগোনা; প্লাস্টিক, পরিত্যক্ত মাছ ধরার যন্ত্রপাতি, তেল বর্জ্য ও অন্যান্য পদার্থ খেয়ে কিংবা পরিত্যক্ত জালের সঙ্গে জড়িয়ে অনেক কচ্ছপ মারা যায়; জলবায়ু পরিবর্তন, পুকুর, জলাশয়ে বিষ ও কীটনাশকের ব্যবহার, জমিতে সার প্রয়োগের কারণে এই প্রাণী বিলুপ্ত হচ্ছে।
সূত্র: বিবিসি
- বিষয় :
- বিলুপ্তপ্রায় প্রাণি
- সরীসৃপ
- দ্বীপ
- কচ্ছপ
- জীববৈচিত্র্য