ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

কর্মসংস্থান

নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস: কোথাও কেউ নেই

নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস: কোথাও কেউ নেই

 ড. সুলতান মাহমুদ রানা

সুলতান মাহমুদ রানা

প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪ | ০৬:৫৬

একসময় মনে করা হতো সরকারি চাকরি পেতে হলে অবশ্যই তদবির প্রয়োজন। এখন অন্তত একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে যে মেধা থাকলে চাকরি নিশ্চিত হয়। এ কথা সত্য বর্তমানে প্রতিযোগিতা বেড়েছে অনেক। মেধাবীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা এখন তুমুল হয়। তবে যারা চাকরির পরীক্ষায় শীর্ষে অবস্থান করেন তারা একটার পর একটা চাকরি পেতেই থাকেন। এমন আশাব্যঞ্জক কথার মাঝেও রয়েছে হতাশা। কারণ, এরই মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনার অভিযোগ আসছে। কোনো তদন্ত কার্যক্রম না করেই ওই পরীক্ষার ফল বিবেচনায় নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তদন্ত না করার প্রবণতা দেখে অনুমান করা যায় যে যারা তদন্ত করার নির্দেশ দেবেন তারা নিজেরাও হয়তো প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত।

বেশ কিছু সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন থেকে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে সক্রিয়। তারা সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে। যেকোনোভাবে চাকরির পরীক্ষায় প্রার্থীদের উত্তীর্ণ করে দেওয়ার কাজে জড়িত তারা। এ জন্য প্রায়ই শোনা যায়, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করেও প্রশ্নের উত্তর কিংবা সমাধানের ধারণা দেওয়া হয় প্রার্থীদের পরীক্ষার হলের বাইরে থেকে। পরীক্ষার শুরুতে পরিদর্শক মারফত নির্দেশনা দেওয়া হয় পরীক্ষার্থীদের। সাধারণত কান খোলা রাখা, মোবাইল ফোন ব্যবহার না করা, ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার না করা প্রভৃতি। কিন্তু যেগুলো নির্দেশনায় থাকে, অনেক সময় সেগুলোও যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। আবার সেগুলো অনুসরণ করা হলেও এর বাইরেও আরও অসংখ্য ডিজিটাল টেকনোলজি রয়েছে, যার ভিত্তিতে অনায়াসেই চাকরির পরীক্ষার প্রশ্নের সমাধানের সুযোগ হতে পারে। সেসব সম্ভাব্য বিষয় নিয়ে আমাদের দেশের প্রযুক্তিবিদগণ যথাযথভাবে কাজ করছেন কিনা সেটি ভেবে দেখা দরকার।

বেশ কয়েক বছর আগে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে একটি আন্দোলন গড়ে তুললেও সাম্প্রতিক সময়ে প্রশ্ন ফাঁসের প্রবণতা আবার মাথাচাড়া নিয়ে উঠেছে ব্যাপকভাবে। গত ৩ মে একটি জাতীয় দৈনিকে ‘উপযুক্ত শাস্তি হোক’ শিরোনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবরের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, সরকারি প্রেসের কর্মী থেকে শুরু করে ছাত্র-শিক্ষক, ব্যাংক কর্মকর্তা অনেকেই এ চক্রের সঙ্গে জড়িত। 

সর্বশেষ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়ে ব্যাপক লেখালেখি এবং সমালোচনা আমাদের নজরে এসেছে। এসব অভিযোগের যথেষ্ট সত্যতা আছে সেটি নিজেরাই অনুধাবন করতে পারি। বিশেষ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, পড়াশোনার মান, তাদের দক্ষতা বা মেধা থেকে অনুমান করা যায় যে উত্তীর্ণদের অনেকেরই সেই ধরনের যোগ্যতা নেই। কারণ, প্রাথমিক সহকারী শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নও যথেষ্ট মানসম্মত। মানসম্মত পরীক্ষায় কোনো ধরনের প্রস্তুতি ছাড়া যে কেউ উত্তীর্ণ হওয়ার প্রবণতাই প্রমাণ করে যে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে কিংবা অন্য কোনো কারসাজি হয়েছে। তারপরও এসব বিষয়ে যথাযথ তদন্ত না করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগ কার্যক্রম চলমান রাখার বিষয়টি কোনোভাবেই মানানসই নয়।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক নিয়োগের সর্বশেষ পরীক্ষায় আবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে। পরীক্ষায় তিন ধাপে প্রায় সাড়ে ১১ লাখ প্রার্থী লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেন। প্রথম ধাপে জালিয়াতির অভিযোগে ৭৪ জন এবং তৃতীয় ধাপে একই অভিযোগে ১৩ জনকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত। প্রাথমিক পর্যায়ে একজন শিশু শিক্ষার্থীর শিক্ষার ভিত গড়ে দিতে হয় তাদেরই। শিক্ষক যদি ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা দিয়ে নিয়োগ পান, তাহলে তারা কেমন কারিগর হবেন, তা বোঝার বাকি নেই। আমাদের প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের যখন মিডিয়াকর্মীরা প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন, তখন তারা বরাবরের মতো একই উত্তর দেন; যাকে আমরা ‘সরকারি বক্তব্য’ বলি।

বক্তব্যের ভাষা ছিল এরকম- “পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। কোনো প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। পরীক্ষার পর এ ধরনের অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।” কতটুকু অবিবেচনাপ্রসূত ও অদক্ষতার পরিচয় এই বক্তব্যের মাঝে রয়েছে, তা বোধহয় ওই কর্মকর্তা ভেবে দেখেননি। 

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের নামে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর আগে সাবেক প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর নামেও নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ গণমাধ্যম সূত্রে পেয়েছি। এমনকি গণমাধ্যম সূত্রে জেনেছি কোনো কোনো প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা ইচ্ছাকৃত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে নিজেরা কোনোভাবেই বদলি হতে চান না। এ জন্য কেউ কেউ দীর্ঘদিন থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরেই রয়েছেন। তারা নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য অনায়াসেই করতে পারছেন বলে নিজেদের বদলির বিষয়ে সচেতন থাকেন। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে গিয়ে দেখা যায় প্রশাসন ক্যাডারের বেশ কিছু কর্মকর্তা বহু বছর ধরে একই পদে  (পরিচালক) বহাল রয়েছেন। 

গত বছরের ২১ মার্চ দেশ রূপান্তরে প্রকাশিত ‘টাকা হলেই বদলি’ শিরোনামে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বদলি নিয়ে অনিয়মের কথা জানা যায়। অধিদপ্তরের নতুন নতুন কৌশলী নীতিমালার কারণে অসংখ্য শিক্ষক বদলি হতে না পেরে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন। কারণ অনেকেই আছেন তাদের নিয়মনীতির বেড়াজালে স্বামীর কর্মস্থলে বদলি হতে পারেন না। বাধ্য হয়ে চাকরি ছাড়তে হয়। 

প্রাথমিক বিদ্যালয় হলো শিক্ষার সূতিকাগার। সেখানে এত অনিয়ম। বিশেষ করে নিয়োগ ও বদলি বাণিজ্য আমাদের ব্যথিত করে তোলে। আমরা হতবাক হয়ে যাই। প্রশ্ন ফাঁস করে নিয়োগ তারপর বদলি– এ নিয়ে ব্যাপক বাণিজ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রশ্নবিদ্ধ নিয়োগে ভবিষ্যৎ জাতি অসারতার দিকে যাক, এমনটি কারও কাম্য নয়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই পুরোনো শঙ্কা আরও ভয়াবহতা পেতে যাচ্ছে। এখন আর কেবল ব্যক্তি নয়, এখন এই সর্বনাশা প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে রাজনৈতিক চক্র এবং বড় বড় মহল।

 ড. সুলতান মাহমুদ রানা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
[email protected]

আরও পড়ুন

×