জীবন যাপন
আমাদের হাতের কাজ শেষ হয় না কেন?

ফাইল ছবি
সাইফুল হোসেন
প্রকাশ: ১০ অক্টোবর ২০২৪ | ০৯:০৪
আমরা প্রায়ই বলি, বাঙালির তিনটি হাত– বাম হাত, ডান হাত ও অজুহাত। এই অজুহাত মানব জীবনের এমন একটি নীরব শত্রু, যা প্রতিনিয়ত আমাদের পিছিয়ে দিচ্ছে। আমরা প্রায়ই ‘এটা কালকে করব’, ‘আরেক দিন শুরু করব’ বলে এই অজুহাতের পেছনে লুকিয়ে থাকি। বাস্তবতা হলো, এই অজুহাতই আমাদের সবচেয়ে বড় বাধা ও সর্বনাশ করছে। প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়, আমরা অনেক কিছুর পরিকল্পনা করি। যেমন কেউ চাকরি পেতে চায়, কেউ ব্যবসা শুরু করতে চায়, আবার কেউ সঞ্চয় শুরু করতে চায়। কিন্তু এসব পরিকল্পনা প্রায়ই বাস্তবায়ন হয় না। কারণ আমরা উদ্যোগী হয়ে কাজে নেমে পড়ি না। আমাদের ইচ্ছা ও কর্মশক্তি দিয়ে কাজ শুরু না করে অজুহাতের আড়ালে নিজেকে বন্দি করে ফেলি। ফলে আমাদের জীবনের অনেক সম্ভাবনাময় সুযোগ হাতছাড়া হয়।
প্রোকাস্টিনেশন বা কাজে ঢিলেমি করা কিংবা বিলম্ব করার অভ্যাসটি আমাদের জীবনের একটি অংশ হয়ে উঠেছে। কোনো কাজ না করার জন্য আমরা নানা ধরনের অজুহাত খুঁজে পাই। ‘এটা পরে করব’, ‘কালকে করব’, ‘আরেকটু প্রস্তুতি নিই’– এ ধরনের আচরণ প্রায়ই আমাদের সঠিক সময়ে কাজ করতে বাধা দেয়। স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন অজুহাতে কাজ না করা কিংবা ঢিলেমি দেওয়া মানুষের মস্তিষ্কের একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা, যা কাজের চাপে বা সংকটের মুখে পড়লে মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবেই কাজটি পিছিয়ে দেয়। এ প্রবণতা আমাদের সম্ভাবনা নষ্ট করে এবং উদ্যোগগুলো মাঝপথে থেমে যায়। আমাদের মধ্যে অনেকেই নতুন কিছু শুরু করার জন্য একটা নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ করি। বাস্তবে সেই দিনটি কখনও আসে না। আমরা বারবার অজুহাত তৈরি করি এবং আমাদের কাজকে পিছিয়ে দিই। এ কারণে অনেক সম্ভাবনা ও আইডিয়া জলে ভেসে যায়।
যে কোনো স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গেলে প্রয়োজন একটি সুস্পষ্ট পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা তাদের লক্ষ্য লিখে রাখে, তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। প্রোকাস্টিনেশন শুধু ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ধ্বংস করে না, এটি আমাদের আত্মবিশ্বাসকেও ক্ষুণ্ন করে। দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রোকাস্টিনেশন দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক চাপ ও হতাশার কারণ হতে পারে। কারণ নিজেরা জানি, আমরা সময়মতো কাজ করছি না। এ প্রবণতা আমাদের ব্যক্তি ও পেশাগত জীবনে বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে। আপনি যদি প্রতিদিনের কাজ বারবার পিছিয়ে দেন, তাহলে এক সময় আপনার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ হারিয়ে যাবে।
প্রোকাস্টিনেশন থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। উদ্যোগী হয়ে কিছু পদক্ষপে নিলেই সেটা সম্ভব। প্রথমত, আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপনি কাজ শুরু ও শেষ করতে বিলম্বের শিকার হতে চান না। স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট একটি রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। পরিকল্পনা করলেই হবে না, সেটি কাগজে লিখে ফেলুন এবং একটি সময়সীমা নির্ধারণ করুন। আপনার পরিকল্পনার প্রতিটি ধাপ বাস্তবায়নে একটি নির্দিষ্ট তারিখ অনুযায়ী এগিয়ে চলুন।
ধরুন, আপনি সিগারেট ছাড়তে চান। একবারে ছাড়ার চেষ্টা না করে প্রথমে দৈনিক সিগারেটের সংখ্যা কমাতে হবে। প্রথম দিন ১২টি, পরের দিন ৮টি। এভাবে ধীরে ধীরে শূন্যতে নিয়ে আসতে হবে। এ প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং মনোবলের প্রয়োজন; তবে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ২০২১ সালের এক গবেষণা অনুযায়ী, বদ-অভ্যাস ত্যাগ করতে ২১ দিনের ধারাবাহিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আপনি যদি ২১ দিন একটি অভ্যাস থেকে দূরে থাকতে পারেন, তাহলে সেই অভ্যাস থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাওয়া সম্ভব। প্রতিদিনের কাজগুলো বারবার পিছিয়ে না দিয়ে আপনি যদি আজ থেকেই কাজ শুরু করেন, তবে দেখবেন আপনার জীবন বদলে যাচ্ছে। আজকের কাজ আজই শেষ করুন। কারণ আজকের অজুহাত ভবিষ্যতের বড় একটি ক্ষতির কারণ হয়ে উঠতে পারে।
প্রোকাস্টিনেশন জীবনের অগ্রগতির বড় এক বাধা, যা আমাদের সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করে দেয়। অজুহাত তৈরি না করে আমাদের আজ থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। জীবনের প্রতিটি কাজে সময়মতো পদক্ষেপ নিতে হবে। আজই একটি বড় স্বপ্ন দেখুন এবং সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পরিকল্পনা শুরু করুন। চলুন, আমরা অজুহাত না দিয়ে কাজে মনোযোগী হই। তাহলে দেখব, আমাদের জীবনের প্রতিটি লক্ষ্য একে একে পূরণ হতে শুরু করছে।
সাইফুল হোসেন: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইন্যান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক এবং ব্যবসায় কৌশলবিষয়ক লেখক
- বিষয় :
- জীবনশৈলী
- প্রোডাক্টিভিটি