ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবারও দলীয় যুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে?

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আবারও দলীয় যুদ্ধের ইতিহাস হচ্ছে?

মোশতাক আহমেদ

মোশতাক আহমেদ

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২১ | আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০০:২২

যুগে যুগে, দেশে দেশে বিজয়ীরাই ইতিহাস লিখে আসছে। বিজয়ীদের শৌর্যবীর্যের কথাই সেখানে থাকে; পরাজিতদের স্থান হয় ‘গাদ্দার’ তালিকায়। বিজয়ী আর বিজিতের মাঝে যে জনগণ, তারা শুধু বিজয়ীদের ইতিহাসই পায়; বিজিতের বা পরাজিতের বয়ান শোনার সুযোগ থাকে না।

বাংলাদেশে বছরে দুটো মাসে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে– মার্চ আর ডিসেম্বর। মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস, ডিসেম্বর বিজয়ের। এ দুই মাস এলেই যে সরকার ক্ষমতায় থাকে, তারা নিজের মতো ইতিহাসের বয়ান তৈরি করে। আর আমজনতা সেই বয়ান যাত্রাপালায় মুখে রঙমাখা চরিত্রের চিৎকারের মতো শুনে যায়। কখনও কোনো করুণ রসে অশ্রুসিক্ত হয়; কখনও বীররসে হাততালি দেয়। পালা শেষে ফিরে গিয়ে লিপ্ত হয় ঘর-গৃহস্থালিতে; যাত্রাপালার কথা মনে থাকে না। এমনটিই হয়ে আসছে চিরকাল।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ছিল টানা দেড় দশক। এই সময়ে তারা নিজেদের মতো ইতিহাসের বয়ান তৈরি করেছে। না; তারা মিথ্যা বয়ান দেয়নি। তবে যা করেছে তা মিথ্যার চেয়েও ভয়ংকর। সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে সত্যকেই করে তুলেছে প্রশ্নবিদ্ধ। 

স্বাধীনতা সংগ্রাম হঠাৎ করেই শুরু হয়নি– কে না জানে! দীর্ঘ ২৪ বছরে তিলে তিলে গড়ে ওঠা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায় ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নিরেট মূর্খ বা ধান্দাবাজ ছাড়া সবাই বলবে, আকস্মিক ঘোষণায় কোনো দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হতে পারে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিপুল আয়োজন যেমন এক দিনে বা এক মাসে সম্ভব হয় না, তেমনি একক ব্যক্তির একক অবদানেও অসম্ভব। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সামষ্টিক অবদানের ফসল।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তাই ১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার সুযোগ নেই। এসব আন্দোলন কোনো একক ব্যক্তির নয়; ছিল আপামর জনতার সামষ্টিক আন্দোলন। এটাও স্বীকার্য, সে সময়ে আওয়ামী লীগই ছিল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। কিন্তু বড় হলেই সব কৃতিত্ব দেওয়া বা নেওয়ার কারণও নেই। যেমন বাষট্টির আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়নসহ বাম রাজনীতিকদের অবদানই ছিল প্রধান। কিন্তু আওয়ামী লীগ সেটা স্বীকার দূরে থাক, তাদের রচিত ইতিহাসের বইয়ে উল্লেখও করতে চায় না। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্র ইউনিয়নের অবদানও কোনোদিন তারা উল্লেখ করেনি। ওই গণঅভ্যুত্থানের ১১ দফার ৫টিই যে বামপন্থিদের মস্তিষ্কপ্রসূত– তা আজকের প্রজন্ম সম্ভবত জানেও না।

মুক্তিযুদ্ধেও বামদের ভূমিকার কথা আওয়ামী লীগ রচিত ইতিহাসে স্থান পায় না। ছাত্র ইউনিয়ন, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টিও যে যুদ্ধ করেছে– যেন তারা জানতই না। এমনকি মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফ্‌ফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধরের কথাও আওয়ামী লীগের মুখে শোনা যায় না। এভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে তারা দলীয় যুদ্ধের ইতিহাসে পরিণত করে ফেলেছিল। শুধু তাই নয়; স্বাধিকার আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর দল আওয়ামী লীগই দলীয় নেতায় পরিণত করেছে।

কেবল আওয়ামী লীগ নয়; বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ যারাই ক্ষমতায় এসেছে, নিজেদের মতো ইতিহাসের বয়ান তৈরি করেছে। ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী পাঁচ দশকের বাংলাদেশে ইতিহাস মানেই দলীয় ইতিহাস। যেসব লেখক বা বুদ্ধিজীবী জনগণের ইতিহাস রচনার কাজটি করতে পারতেন, তারাও সরকারি আনুকূল্যের লোভে সত্যিটা জাতির সামনে তুলে ধরতে পারেননি। ফলে মুক্তিযুদ্ধের নির্মোহ ইতিহাস আজও রচিত হয়নি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, যতদিন জাতির নির্মোহ ইতিহাস রচিত না হবে ততদিন জনগণ সেই ইতিহাসের অংশ হতে পারে না। আর জনগণ যদি ইতিহাসের অংশ না হয়, সেটা টেকসই হতে পারে না।
৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর নতুন করে ইতিহাসের বয়ান শুরু হয়েছে। এর লক্ষ্য আওয়ামী লীগের করা সবকিছু উল্টে দেওয়া। অস্বীকারের উপায় নেই, আওয়ামী লীগ অনেক ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি ও অতিরঞ্জন করেছে। বিশেষত বঙ্গবন্ধুর অবদান বড় করতে গিয়ে অনেক জাতীয় নেতার অবদান অস্বীকার বা খাটো করেছে। মুক্তিযুদ্ধের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী, জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমানসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের অন্যান্য জাতীয় নেতা বা রণাঙ্গনের অধিনায়কদের নাম উল্লেখে সযত্নে বিরত থেকে প্রকারান্তরে ইতিহাসই বিকৃত করেছে। 
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার কোনো দলীয় প্রতিনিধিত্ব না করায় স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল, তারা ইতিহাসের দিকে নির্মোহ দৃষ্টি দেবে। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অবদান অস্বীকার করা হচ্ছে, সেটাও ইতিহাসের ডাহা বিকৃতি বৈ অন্য কিছু নয়। এমনকি যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাজাপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর পুত্র মাসুদ সাঈদীও সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধের টোটাল অভিযোগটাই হলো একটা নাটক (সমকাল, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪)।’

আওয়ামী লীগ আমলে দেখেছি, ২৬ মার্চ বা ১৬ ডিসেম্বর প্রশাসন আয়োজিত অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতানেত্রীকে দাওয়াত দেওয়া হতো। অন্য দলের কাউকে পারতপক্ষে দাওয়াত দেওয়া হতো না। ফলে এসব অনুষ্ঠান পর্যবসিত হতো দলীয় সভায়। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর আশা ছিল, সেই সংস্কৃতির অবসান ঘটবে। কিন্তু এবার বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের অংশীজন বিএনপি ও জামায়াত ছাড়া অন্য দলকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। আলোচনায় ইতিহাসের বয়ানও ছিল তথৈবচ। 
অনেক এলাকায় বিজয় দিবসের দাওয়াতপত্রে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আবু সাঈদের ছবি দেওয়া হয়েছে। তাঁর অবদান ও আত্মত্যাগ নিশ্চয় খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু বিজয় দিবসের দাওয়াতপত্রে তাঁর ছবি ব্যবহার কতটুকু প্রাসঙ্গিক? হতে পারে, সরকারের উঁচু মহলের এমন নির্দেশনা ছিল না; স্থানীয় কর্তৃপক্ষই করেছে। আওয়ামী লীগ আমলেও অতি উৎসাহী কর্মকর্তারা এমন অনেক কাজ করতেন। অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও কি সেটা শুরু হয়ে গেল?

আওয়ামী লীগ-বিরোধিতার নামে মুক্তিযুদ্ধের সব অর্জন ও চিহ্ন মুছে ফেলার প্রয়াস প্রমাণ করছে– অতীতের মতো জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে বিজয়ীরাও নিজেদের মতো ইতিহাস লিখতে চাইছে। আবারও কি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস দলীয় যুদ্ধের ইতিহাস হয়ে উঠবে? যুগে যুগে এভাবেই ইতিহাস বিকৃত হয়।

মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; সাবেক জাতিসংঘ কর্মকর্তা

আরও পড়ুন

×