ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

বড়দিনে কিছু ছোট কথা

বড়দিনে কিছু ছোট কথা

বিধান রিবেরু

বিধান রিবেরু

প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৪ | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ | ২৩:৫৫

রাষ্ট্র সুস্থির না হলে কোনো সংবেদনশীল মানুষের পক্ষেই স্থির হয়ে কোনো কিছু চিন্তা করা সম্ভব হয় না। অস্থিরতা– বদ্ধ ঘরে মক্ষিকা ওড়ার মতো একঘেয়ে শব্দ উৎপাদন করে; মানুষ নিস্তার চায় কিন্তু পায় না। উৎসবের বেলায়ও তাই, সে হোক বড়দিন কিংবা অন্য কোনো ধর্মীয় বা জাতীয় উৎসব; মানুষের স্বস্তি থাকে না। এতদিন শোনা যাচ্ছিল– ধর্ম যার যার উৎসব সবার। ইদানীং এর উল্টো সুর বাজতে শুরু করেছে শিথানে। ধর্ম যার যার তো বটেই, উৎসবও তার তার। কারণ একের উৎসবে অন্যে গেলে বাইবেল অশুদ্ধ হয়ে যেতে পারে! এই মতাদর্শই দিন দিন বাড়ছে বাংলাদেশে। কেমন যেন অসহিষ্ণু হয়ে উঠছি আমরা। শুধু নিজেদেরটাই বুঝি। অন্যের আনন্দে আনন্দিত হওয়ার বদলে আমরা হয়ে উঠি ঈর্ষান্বিত কিংবা রাগান্বিত। 

চলচ্চিত্র সমাজেরই আয়না– বলে লোকে। তো সেটি যদি একরত্তি সত্যিও হয়, তাহলে তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পারে’ ছবির কথা যদি মনে থাকে, ওই যে লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়ার রূপক। সম্প্রদায়ের ভাগে দুই রং। কালোরা ভালো, লালেরা খারাপ। কারণ ওরা কামড়ায়! ছেলেবেলার দুই বান্ধবী, দুই সম্প্রদায়ের। কিন্তু ধর্মের কারণে দেশভাগ হলে তাদের আর কী করার থাকতে পারে? সম্প্রতি দেখা হলো ‘প্রিয় মালতী’, সেখানেও দেখা যায় সেই একই ব্যাপার– আমরা আর তোমরা। পূজার ঘণ্টা সেখানে আইসক্রিমের ঘণ্টায় পর্যবসিত হয় মালতীর বাড়িওয়ালার কাছে।

রিল থেকে রিয়েল লাইফ আরও রূঢ়। এক শিশু আরেক শিশুকে বলে ওঠে, অনায়াসে– যাও, তোমরা অমুক ধর্মের, তোমার সঙ্গে খেলব না! ধর্মের এই ভেদ আসে কোথা থেকে? মাটি ফুঁড়ে বের হয়? না আকাশ থেকে পড়ে? মানুষের মস্তিষ্কেই আসমান আর জমিন; সেখানেই সব হিসাবনিকাশ। অথচ এই হিসাব একেবারেই অকেজো গভীর বনানীতে। তবে কে বা কারা সভ্য? ধর্মের নামে রাজনীতি ও ভূরাজনীতির ফায়দা লোটা যায় কোন কারণে? মানুষের মননে সাম্প্রদায়িকতার চাষাবাদ কি চলতেই থাকবে? ধর্ম পালন করেও তো অন্য ধর্মের মানুষকে ভালোবাসা যায়। অনেকে হয় তো এক কাঠি এগিয়ে বলবেন, নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করলে অন্যেরটা খর্ব হবেই। কাজেই ওটি পরিত্যাজ্য! কথায় যুক্তি আছে। তবে কী মানুষের পরম প্রয়োজন? সে নিজেকে চারিত্রিক কারণেই অসহায় ভাবে; ভঙ্গুর অনুভব করে। কারও কাছে নৈবেদ্য নিয়ে মানুষ মাথা অবনত করে শান্তির বর্ষণে স্নাত হতে চায়। মানুষ শান্তি চায়। কিন্তু হায়! অশান্তিই তার জন্মসঙ্গী।

যিশু খ্রিষ্ট থেকে শুরু করে প্রত্যেক মহাপুরুষকে অশান্তির মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ক্রুশবিদ্ধ হওয়া ললাটের অলঙ্ঘনীয় বিধান। তা খণ্ডন করার প্রয়াস আছে বলেই মানুষ মানসিক প্রশান্তির খোঁজ করে; উৎসবের মধ্য দিয়ে মিলিত হতে চায় পরিবার-পরিজন ও প্রতিবেশীর সঙ্গে। সেখানে ধর্ম পরিচয় হয়ে ওঠে গৌণ। এই বোধ আলোকিত মানুষের বৈ অন্যের নয়। অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষ গণ্ডি তৈরি করে। এর পর ধীরে ধীরে তার মাথা পরিণত হয় কূপমণ্ডূকে। অবশ্য মানব সভ্যতার হিসাব করলে সেখানে কূপমণ্ডূকতার ইতিহাস কম পাওয়া যাবে না। ঐতিহাসিক সত্য হলো– মানুষ ইতিহাস থেকে কিছু শেখে না। তারা বারবার বিবাদে জড়ায়; জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ক্ষমতার নামে। 

অনেকে ক্ষমতা ছাড়তে চায় না। ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে ধর্মকে করে তোলে রাজনৈতিক হাতিয়ার। কেউ আবার ধর্মকেই ব্যবহার করে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের জন্য। ঠিক এই জায়গায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে মনে পড়ে। মানুষকে কি কঠোর সমালোচনাই না তিনি করেছেন: ধর্মে আছো জিরাফেও আছো? সব কিছুতেই থাকতে চাওয়ার বাসনা অথবা নানাবিধ চাওয়া চরিতার্থ করার খায়েশ মানুষকে কি মনুষ্যত্বের জায়গা থেকে কিছুটা বিচ্যুত করে না? নিজের নানাবিধ কামনা-বাসনা চেপে রাখার নামই কি প্রকারান্তরে সভ্যতা নয়? সবকিছু কি আদৌ চেপে রাখা যায়? রবীন্দ্রনাথ কি এ কারণেই লিখলেন ‘সভ্যতার সংকট’? অন্তঃসারশূন্যতা কি কেবল বিশেষ এক জাতিরই বৈশিষ্ট্য? কিংবা বাড়িয়ে বললে, বিশেষ কোনো ধর্ম বা বর্ণের? গোটা মানব জাতিই কি শূন্যতায়, এক গভীর সংকটে নেই? তার অন্তঃসারশূন্যতার খতিয়ান দিয়ে কি শেষ করা যাবে? 

সংকট আছে বলেই মানুষ সমাধান খোঁজে। ঘুরিয়ে বললে, যে জিনিসের সমাধান নেই, তা নিয়ে সংকটও তৈরি হয় না। সংকট ও সমাধানের ভেতরেই মানুষ মুক্তি খোঁজে। ইম্যানসিপেশন। মানব জাতিকে যেমনটা মুক্তি দিতে চেয়েছিলেন যিশু খ্রিষ্ট; তাদের সব পাপ-তাপ থেকে। ক্রুশকাষ্ঠে কীলকবিদ্ধ ও বর্শার খোঁচায় বিক্ষত যিশু রক্ত ঝরাতে ঝরাতে বলেছিলেন: এলি এলি লামা সবকথানি? অর্থাৎ ঈশ্বর, ঈশ্বর, কেন আমায় পরিত্যাগ করলে? এ ক্রন্দন কষ্টের। নিজের জীবনকে বলিদানপূর্বক তিনি সমগ্র মানব জাতির মুক্তি প্রত্যাশা করেছিলেন। এমন পরিত্রাতা পাওয়া, রাজনৈতিক পরিত্রাতা যে কোনো দেশের জন্যই বেশ সৌভাগ্যের বিষয়।

আমাদের সুস্থির রাষ্ট্র ও অসাম্প্রদায়িক সুস্থ মস্তিষ্ক কে উপহার দেবে, আমরা জানি না। এই প্রত্যাশায় ২০০ বছর অপেক্ষা করতে হবে কিনা, জানি না। তবে মানুষ বর্তমানে বাঁচে। অতীত ও ভবিষ্যৎ মানুষের বেঁচে থাকার দিকনির্দেশনা ও অবলম্বন হতে পারে মাত্র। আমরা মরে গেলে আমাদের অধিক কিছু হয় তো থেকে যাবে আমাদের না-থাকাজুড়ে। তবে এই যে বর্তমানে বেঁচে থাকা, সেখানে যদি সুখ ও শান্তি না থাকে, তাহলে কি মানুষ মুক্ত মন নিয়ে উৎসব করতে পারবে? বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্ধশত বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও কেন মনে 
ভয় ও শঙ্কা কাজ করবে, বিশেষ করে ধর্মীয় উৎসবকালে? কেন তাদের উপাসনালয় ঢেকে দেওয়া হবে নিরাপত্তার চাদরে। শীতের রাতে হিমের চাদর ভেদ করে বলগা হরিণ টানা লাল-সবুজ সজ্জার স্লেজ গাড়িতে যে সান্তা ক্লজ আসার কথা ২৫ ডিসেম্বর, সে কি বাংলাদেশের মাটিতে অবতরণ করতে পারবে নির্বিঘ্নে? নাকি ছিনতাই-রাহাজানি বেড়ে যাওয়া নগর তাকেও বরণ করে নেবে কেড়ে নেওয়ার ভেতর দিয়ে?

যাক, এত ভয় ও শঙ্কা পুষে কী হবে? দিবস আসবে দিবসের নিয়মে। প্রত্যাশাটুকুই সম্বল। অতএব, সবাইকে বড়দিনের শুভেচ্ছা।

বিধান রিবেরু: প্রাবন্ধিক ও চলচ্চিত্র সমালোচক        

আরও পড়ুন

×