ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

অধিকার

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বনাম মব সন্ত্রাস

তানিয়া খাতুন

তানিয়া খাতুন

প্রকাশ: ২৫ জুন ২০২৫ | ০০:২৫

চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠনের জন্য অপরিহার্য। এই স্বাধীনতাগুলো যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন ভলটেয়ারের ‘আমি তোমার কথার সঙ্গে হয়তো একমত নাও হতে পারি; কিন্তু তোমার কথা বলার অধিকারের জন্য মৃত্যু পর্যন্ত লড়াই করব’ উক্তিটি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ অনেকের আন্দোলনে যোগ দেওয়ার অন্যতম কারণ ছিল মৌলিক অধিকারের সুরক্ষা। আর মৌলিক অধিকারের অন্যতম ভিত্তি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর ভিন্নমত ও চিন্তার বৈচিত্র্য মানুষ বিভিন্নভাবে বাধাপ্রাপ্ত হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে দেশে গুজব ছড়ানো ও মব ভায়োলেন্সের পুনরাবৃত্তি রোধে উচ্চ আদালতের হাইকোর্ট বিভাগ যে ৫ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন, তার বাস্তব প্রয়োগ প্রায় কোনো ঘটনায়ই দেখা যায়নি। অথচ দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে মতপ্রকাশকে কেন্দ্র করে মব ভায়োলেন্স।

সাম্প্রতিক সময়ের কয়েকটি ঘটনার দিকে দৃষ্টি রাখলে পরমতসহিষ্ণুতা কমে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যদিও এর বেশির ভাগ ভুক্তভোগীই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের; বাদ যাচ্ছেন না সংখ্যাগুরুরাও। ভিন্নমতকে গ্রহণ করার উদারতা কমতে কমতে মানুষ ভিন্নমত, চিন্তা ও  ধর্মকে কোণঠাসা করে নাগরিকদের মধ্যে বিভাজন শুরু করে দিয়েছে। দেশের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ও মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) সংগৃহীত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে ২০ জুন পর্যন্ত ভিন্নমত প্রকাশের ১১টি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দণ্ডবিধির বিভিন্ন ধারায় গ্রেপ্তার হয়েছেন ৮ ব্যক্তি। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ (২৪) ফেসবুকে ধর্ম নিয়ে এক পোস্টে মন্তব্য ঘিরে চাপ ও ভয়ভীতির মুখে আত্মহত্যা করেন। ভুক্তভোগীর বাড়িঘরে আক্রমণ, লুটপাট, ভাঙচুরও ঘটেছে। অনেক ক্ষেত্রে জনরোষ থেকে জীবন বাঁচাতে পরিবারই পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে ভুক্তভোগীকে। সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। 

চলতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত সাইবার নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ৯টি এবং গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬ জন। মামলাগুলোর মধ্যে ধর্ম নিয়ে কটূক্তির ৪টি, মানহানির ৪টি, সংবাদ প্রকাশের ১টি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে যে কয়টি ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তার মধ্যে অন্যতম সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ জারি। আগের আইনের ৯টি ধারা বাদ পড়েছে। তবে বাদ পড়া ধারার কিছু বিধান নতুন অধ্যাদেশে রয়েছে। অধিকারকর্মী ও জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয় এ অধ্যাদেশকে আগের তুলনায় উন্নত বললেও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় যে বাধা, তা অনেক ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে।

যেমন, অধ্যাদেশের ২৬ ধারায় সাইবার পরিসরে জাতিগত বিষয়ে সহিংসতা, ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক তথ্য প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে ‘ঘৃণা বা ‘বিদ্বেষমূলক’ বক্তব্যের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এখানে অপরাধের সংজ্ঞায়ন এমনভাবে করা হয়েছে, তা অনেক ক্ষেত্রে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বা ধর্মীয় বিশ্বাসের স্বাধীনতার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। 
সংশোধিত অধ্যাদেশের ২৭ ধারায় অপরাধ সংঘটনে ‘সহায়তা’ করলে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু ‘সহায়তা’ কী, তা সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এতে এ ধারার ফাঁকে কর্তৃপক্ষ কাউকে অযৌক্তিকভাবে ফৌজদারি অপরাধে জড়িত করতে পারে। 
সাইবার সন্ত্রাসকে সাইবার নিরাপত্তা আইনের মতোই রাখা হয়েছে সংশোধিত অধ্যাদেশের ২৩ ধারায়। অথচ এ ধারাটির অস্পষ্টতা রাজনৈতিক, মানবাধিকারকর্মীসহ সাংবাদিকদের বৈধ মতপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করবে বলে  বাতিলের দাবি ছিল অধিকারকর্মীদের। 

অধ্যাদেশের ১৭ ধারায় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর সংজ্ঞা যথেষ্ট স্পষ্ট না হওয়া এবং কোন কোন কম্পিউটার সিস্টেম বা নেটওয়ার্কের অন্তর্গত হবে, তা নির্ধারিত না থাকায় অনেকের কাছেই এই সংজ্ঞা অস্পষ্ট মনে হতে পারে। এ ক্ষেত্রে কেউ অপরাধ করছেন কিনা, সে ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়েই বা ভুলবশত কোনো অপরাধ করে ফেলতে পারেন। একই সঙ্গে ‘গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামো’র বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে কী ধরনের কার্যক্রম বোঝাবে, তারও কোনো সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই। তাই ভয়ের কারণ থেকেই যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পরিকাঠামোর কোনো তথ্য বা উপাত্ত অননুমোদিতভাবে প্রকাশ করাকেও অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ রয়েছে।

মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সংশোধনীর ২৩ (ঘ) ধারায় ‘হুইসেলব্লোয়ার’দের ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ আইনের আওতায় আনা যাবে না, বলা হয়েছে। কিন্তু ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’র কোনো ব্যাখ্যা অধ্যাদেশে দেওয়া হয়নি। ফলে ভিন্নমত প্রকাশে এ আইনের অপব্যবহারের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে।
এই অধ্যাদেশে ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ইন্টারনেট সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সব তথ্য কোনো রকম প্রক্রিয়া ছাড়াই বা আদালতের অনুমতি ছাড়াই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। নাগরিকের তথ্য সুরক্ষার দায়িত্ব সেবা প্রদানকারী সংস্থা তথা কোম্পানিরও রয়েছে। তাই এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া না থাকায় সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃত্ব পুরোপুরি বহাল থাকবে।

বহু জাতি, ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতির বৈচিত্র্যপূর্ণ বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হাজারো মানুষ শহীদ হলেন; গুরুতর আহত হলেন এবং দৃষ্টিশক্তি হারালেন, তা সফল হবে তখনই যখন সব ধরনের বিশ্বাস ও মতের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত হবে। মব সন্ত্রাসের কাছে মতপ্রকাশের সহজাত আকাঙ্ক্ষা যখন হার মানবে না। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য অনুধাবন করে সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস।

তানিয়া খাতুন: মানবাধিকারকর্মী; হিউম্যান
রাইটস মনিটরিং অফিসার, মানবাধিকার
সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)

আরও পড়ুন

×