প্রাণ পাচ্ছে আউটার স্টেডিয়াম

খেলোয়াড় তৈরির কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত আউটার স্টেডিয়াম ছিল দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত। এখন সেটিকে আবার খেলাধুলার উপযোগী করে তোলা হচ্ছে মো. রাশেদ
শৈবাল আচার্য্য
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪ | ২৩:২১
অবৈধদের দখলে চলে যায় খেলার মাঠ। প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে মাঠের ভেতরেই গড়ে তোলা হয় অঘোষিত ‘গাড়ি রাখার টার্মিনাল’। বছরের বেশি সময় ধরে এখানে চলত মেলা। মাঠের চারপাশে ছোট-বড় রেস্টুরেন্টসহ নানা স্থাপনা নির্মাণ করে দখলে নেয় দখলদাররা। দিনের পর দিন মাঠে জমে থাকত আবর্জনার স্তূপ; রাতে বসত মাদকসেবীদের আসর। দখলদারদের কালো থাবায় মাঠ থেকে হারিয়ে যায় সবুজ ঘাস; বন্ধ হয়ে যায় খেলাধুলাও। পাড়ার শিশু-কিশোর, তরুণদের নিয়মিত অনুশীলন গিয়েছিল নির্বাসনে। গ্রীষ্মে ঘাস হারিয়ে ধুলোর প্রান্তর আর বর্ষায় জল-কাদার আধারে পরিণত হতো চট্টগ্রাম নগরের কাজির দেউড়ির এমএ আজিজ স্টেডিয়ামসংলগ্ন আউটার স্টেডিয়াম। অথচ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক অর্জন-সাফল্যের সাক্ষী এই মাঠ। জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খানের মতো খেলোয়াড় তৈরি হয়েছে এই মাঠে খেলে। তবে দীর্ঘদিন পর হলেও দখলদারদের হাত থেকে মুক্ত হওয়া আউটার স্টেডিয়াম ফিরে পাচ্ছে নতুন ‘প্রাণ’। সবুজ ঘাসে নান্দনিকভাবে পুরোনো রূপ ফিরে পাচ্ছে ঐতিহাসিক এ খেলার মাঠে। তিন দশক ধরে পতিত জমিতে পরিণত হওয়া আউটার স্টেডিয়াম এখন যেন ‘সবুজ গালিচা’।
এই মাঠে একটু একটু করে লাগানো হয়েছে সবুজ ঘাস। এখন সবুজে ভরে গেছে কয়েকদিন আগেও ধুলো আর বালিতে ভর্তি থাকা পুরো মাঠ; যা দূর থেকে প্রথম দেখাতেই যে কারও মনে হবে এ যেন গ্রামের কোনো কৃষিজমি বা খেলার সবুজ মাঠ। পুরো মাঠ সবুজ ঘাসে ভরে যাওয়ায় এটি আশপাশের এলাকার চেহারাও বদলে দিয়েছে। তবে এমন পরিবর্তন ছিল চ্যালেঞ্জের; ছিল অনেক কঠিনও। তারপরও হারিয়ে যাওয়া সবুজ ঘাসের নান্দনিক আউটার স্টেডিয়ামটি চট্টগ্রামবাসীকে আবারও ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। পদাতিকার বলে তিনি আবার চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতিও। তাঁর নেওয়া বেশকিছু উদ্যোগে আবারও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে মাঠটি। যে মাঠ এতদিন বছরজুড়ে দখলদার আর মেলার দখলে ছিল, সেখানে শিগগির আবারও শুরু হবে খেলাধুলা। মাঠের চারপাশে নিয়মিত হাঁটাচলা, ব্যায়াম করতে পারবেন সাধারণ মানুষ। সবুজ ঘাসে পরিণত হওয়ায় আবারও এই মাঠ থেকে জাতীয় পর্যায়ে তারকা মানের খেলোয়ার উঠে আসবে বলে মনে করছেন চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংগঠকসহ সংশ্লিষ্টরা।
চট্টগ্রামে এক সময়ের খেলোয়াড় তৈরির কারখানা ছিল আউটার স্টেডিয়াম। এ মাঠেই নিয়মিত খেলতেন জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক আকরাম খান, তামিম ইকবাল, নান্নু থেকে শুরু করে নাফিস ইকবাল, আফতাব হোসেনসহ আরও কয়েকজন। কলকাতা ইস্ট বেঙ্গল টিমও খেলেছে এ মাঠে। স্টার সামার, স্টার যুব টুর্নামেন্টের মত বড় বড় টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়েছে এখানেই। যেখানে খেলেছে দেশ-বিদেশের অনেক নামিদামি ক্রিকেটার। কিন্তু গত তিন দশক ধরে দখলদারদের থাবায় এটি পরিণত হয় জঞ্জালে। সৌন্দর্য বর্ধনের নামে এটিকে পরিণত করা হয় ব্যবসায়িক জোনে। অথচ দেশের ক্রীড়াঙ্গনের অনেক অর্জন-সাফল্যের স্বাক্ষী এই মাঠ। খ্যাতিমান স্থপতি আশিক ইমরানের নকশায় ও চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার (সিজেকেএস) অর্থায়নে মাঠটি এই অঞ্চলের হাব-এ পরিণত হতে যাচ্ছে। এতে স্বস্তি ফিরে পাচ্ছেন চট্টগ্রামের ক্রীড়াপ্রেমীরা।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, একটু একটু করে পুরো মাঠেই লাগানো হয়েছে সবুজ ঘাস। এসব ঘাস পরিচর্যায় প্রতিদিন সকাল থেকেই কয়েক ধাপে নিয়মিত দেওয়া হচ্ছে পানি। এরই মধ্যে বেশকিছু স্থানে লাগানো ঘাস হয়েছে বেশ বড়। শ্রমিকরা হারিয়ে যাওয়া এই মাঠকে নতুন রূপ ফিরিয়ে দিতে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। ঘাস বৃদ্ধিতে যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেজন্য মাঠে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না কাউকে। মাঠের চারপাশে এরইমধ্যে দেওয়া হয়েছে লোহার বেষ্টনী। এর আগে শেষ করা হয়েছে বালু ভরাট ও ফিনিশিংয়ের কাজ। বর্তমানে সবুজে আবৃত হয়ে জঞ্জালে পরিণত হওয়া মাঠটি পেয়েছে নান্দনিক রূপ।
চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাহী কমিটির সদস্য কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব সমকালকে বলেন, ‘খেলার মাঠে মেলা নয়– এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। আমরা দলীয় সভাপতির এমন নির্দেশনার বাস্তবায়ন চাই। কারণ চট্টগ্রামে এক সময় অনেক মাঠ ছিল। কিন্তু এখন মাঠের স্বল্পতার কারণে চাইলেও অনেক টুর্নামেন্ট করা সম্ভব হয় না। এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের ভেতরে রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান হলে খেলা বন্ধ রাখতে বাধ্য হতে হয়। অনেকদিন পর আউটার স্টেডিয়ামটি দখলমুক্ত হয়ে সবুজ ঘাসে পরিণত হওয়ায় এখন থেকে সেখানে ছোট-বড় টুর্নামেন্ট করা যাবে। এজন্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের নেওয়া নানা উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার।’
বিপর্যস্ত আউটার স্টেডিয়ামের চারপাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে গত ২৯ সেপ্টেম্বর উন্নয়ন কাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জেলা প্রশাসক ।
আউটার স্টেডিয়াম সংস্কারে সিজেকেএসের নিজস্ব অর্থায়নে এক কোটি ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। মাঠটির আয়তন প্রায় ১১ হাজার বর্গফুট। এরমধ্যে ৮ হাজার বর্গফুট জুড়েই থাকবে খেলার মাঠ। যেখানে মূলত বয়সভিত্তিক খেলাধুলা অনুষ্ঠিত হবে। থাকবে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ও লিগ টুর্নামেন্ট। প্রকল্পের আওতায় প্রথম ধাপে মাঠে ঘাস লাগানো হয়েছে। সাধারণত রোপণ পদ্ধতির মাধ্যমে ঘাস গজানো হয়। তবে এখানে ঘাস গজানোর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আধুনিক স্প্রেডিং পদ্ধতি। দ্বিতীয় ধাপে গ্যালারি ও ড্রেসিং রুম করা হবে। ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য থাকবে নেট। ভলিবল আর হ্যান্ডবলের কোর্টসহ থাকবে আরও অনেক কিছুই।
গত বছরের ১৯ মার্চ আউটার স্টেডিয়ামের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের পর একই বছরের সেপ্টেম্বরে আউটার স্টেডিয়াম সংস্কার কাজের উদ্বোধন করা হয়। বিশিষ্ট স্থপতি আশিক ইমরানকে দিয়ে করানো হয় নকশা। যেখানে গ্যালারি, ওয়াকওয়ে, সবুজায়নে বৃক্ষ রোপণসহ নানা পরিকল্পনা রয়েছে। তবে সবার আগে খেলাধুলার জন্য যে জিনিসটি দরকার সেই মাঠ প্রস্তুতির কাজ প্রায় শেষের দিকে। এখন খেলাধুলার আতুড়ঘর আউটার স্টেডিয়াম আবার ক্রীড়াবিদদের পদভারে মুখর হওয়ার অপেক্ষা।
চট্টগ্রামের ক্রীড়াবিদ এবং ক্রীড়া সংগঠকদের মতে, জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান যেভাবে আউটার স্টেডিয়ামের হারানো রূপ ফেরাতে পেরেছেন সেটা অনুকরণীয়। দখলদারদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া মাঠটি যাতে অক্ষত থাকে সেজন্য বর্তমান ডিসি চট্টগ্রাম থেকে চলে যাওয়ার পর যাতে পরবর্তীতে যিনি আসবেন তাকেও যদি বুঝিয়ে দিতে পারেন তাহলে এই মাঠ খেলাধুলার জন্য থাকবে। না হয় কালো থাবায় পড়ে মাঠটি আবারও দখলদারদের হাতে চলে যেতে পারে। কারণ অনেকে অপেক্ষায় আছে কখন বর্তমান ডিসির বদলি হয় সেই আশায়। পাশাপাশি এই মাঠের নিরাপত্তা বিধান করাও এখন সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জের কাজ। পাড়ার ছেলে-মেয়েরাও যাতে এখানে নিয়মিত খেলাধূলা করতে পারে সেদিকটিও নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্টদের।
আউটার স্টেডিয়ামে মেলা বন্ধ করল জেলা প্রশাসন চট্টগ্রামের আউটার স্টেডিয়ামে মেলার আয়োজন করেছিল চট্টগ্রাম লিডিং ই-কমার্স সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তবে গতবছরের ৯ মার্চ মেলার খবর পেয়ে সেদিন দিবাগত রাতে দুই নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে জেলা প্রশাসন থেকে একটি টিম পাঠান জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান। নির্দেশনা অমান্য করে মেলার আয়োজন নিমিশেই পণ্ড করে দেন তারা। একপর্যায়ে ডিসির নির্দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. তৌহিদুল ইসলাম ও মো. রাজিব হোসেন অভিযান পরিচালনা করে মেলা বন্ধ করে দেন। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়- ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আউটার স্টেডিয়ামে কোনো মেলা হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। এই জায়গা সংরক্ষিত থাকবে বাচ্চাদের খেলার জন্য। একই বছরের ২ মার্চ চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি এবং জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান গণমাধ্যমে ঘোষণা দেন, চট্টগ্রামের মানুষের ক্রীড়া ও বিনোদনের জায়গা হিসেবে আউটার স্টেডিয়ামকে একটি দৃষ্টিনন্দন মাঠে রূপান্তর করার। অথচ এমন নির্দেশনাকে অমান্য করে সেখানে মেলা আয়োজনের কর্মযজ্ঞ শুরু করে লিডিং ই কমার্স সোসাইটি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। খবর পেয়ে তাই সেখানে অভিযান পরিচালনা করে নির্দেশনা অমান্য করে মেলার আয়োজনের প্রমাণ পাওয়ায় তাৎক্ষণিক মেলা বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেলা প্রশাসকের এমন সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানান চট্টগ্রামের সর্বস্তরের মানুষ।
বন্ধ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলাও : এমএ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন আউটার স্টেডিয়াম মাঠে প্রায় তিন দশক ধরে ঐতিহ্যবাহী ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা’ অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। তবে গতবছর এখানে আর মেলা করতে দেয়নি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। খেলার মাঠকে ‘মেলামুক্ত’ করার অঙ্গীকার হিসেবেই এমন সিদ্ধান্ত নেন প্রশাসন।
এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান বলেন, ‘খেলার মাঠে মেলা নয় খেলাই হবে- এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা ও ঘোষণা। আমরা তার এই নির্দেশনাকে সাধুবাদ জানাই। তার নির্দেশনার বাস্তবায়ন করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তারই প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামে খেলার মাঠে মেলা নয়; খেলা ফিরিয়ে আনতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
২০২৩ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের সভাপতিত্বে চট্টগ্রামের উন্নয়ন সংক্রান্ত একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সবার মতামতের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম শহরের কোনো খেলার মাঠে আর মেলা করতে দেয়া হবে না বলে সিদ্ধান্ত হয়। বিজয় মেলাসহ সব ধরনের মেলার জন্য আলাদা ভেন্যুর বিষয়েও সভায় আলোচনা হয়েছে। আমরা প্রাথমিকভাবে পতেঙ্গায় বে-টার্মিনালের যে প্রস্তাবিত স্থান রয়েছে তার উল্টোদিকে সিডিএ’র একটি মাঠ আছে সেটি নির্ধারণ করেছি। সলিমপুরে আমাদের যে ফ্লাওয়ার পার্ক হয়েছে তার পাশে সাত একর একটা জায়গা আছে। সেটা আমরা বাণিজ্যমেলার জন্য তৈরি করে দেব। সেখানে বিজয়মেলাও হবে।’
- বিষয় :
- স্টেডিয়াম