ঢাকা বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫

দরিদ্র পরিবারের মেয়ে শিমার সাফল্য

অভাবে মেডিকেলে পড়া নিয়ে শঙ্কা

অভাবে মেডিকেলে পড়া নিয়ে শঙ্কা

শিমা আক্তার

 কমলনগর (লক্ষ্মীপুর) প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫ | ০০:৫৬

অভাবের সংসার। অসুস্থ বাবার আয়-রোজগার না থাকায় স্বল্প আয়ের বড় ভাইদের ওপর নির্ভর পুরো পরিবার। যে কারণে বেতন-পরীক্ষা ফিসহ বিভিন্ন খরচ চালানো অসম্ভব হওয়ায় স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। সবার সহযোগিতায় গত বছর কোচিং করেও ভর্তির সুযোগ মেলেনি। তবুও থেমে যাননি দরিদ্র পরিবারের সন্তান মেধাবী শিমা আক্তার। জেদ ধরেন মেডিকেলে পড়ার। তাই টাকার অভাবে পুনরায় কোচিং করতে না পারলেও এবার আর চেষ্টা বিফলে যায়নি তার। বাড়িতে বসে পড়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছেন কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজে। ১৯ জানুয়ারি প্রকাশিত ফলাফলে এ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন তিনি। শিমার কৃতিত্বে খুশি শিক্ষক ও স্বজনরা।
শিমার মা আয়েশা বেগম জানান, ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল শিমার। অনেক কষ্টের পরও মেয়ের এমন কৃতিত্বে তারা আনন্দিত। তবে এর মধ্যে রয়েছে দুশ্চিন্তাও। কারণ, তার দুই ছেলে যে আয় করে তা দিয়ে সংসারের খরচ ও মেয়ের মেডিকেলের পড়াশোনার খরচ মেটানো অনেকটাই অসম্ভব।
পরিবার ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, ছোটবেলা থেকে পড়ালেখার প্রতি শিমার প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফলাফল করেন তিনি। স্থানীয় চরপাগলা পাটওয়ারীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ভর্তি হন চরকালকিনি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ৪.৮৯ জিপিএ নিয়ে ২০২১ সালে এসএসসি পাস করে ভর্তি হন লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে। কিন্তু বাড়ি থেকে জেলা শহরের এ কলেজটিতে যাতায়াতের খরচ বহন করা সম্ভব না হওয়ায় নিয়মিত যাওয়া হতো না তার। তবুও সেখান থেকে ৪.৮৩ জিপিএ নিয়ে ২০২৩ সালে এইচএসসি পাস করেন শিমা। ওই বছর চেষ্টা করেও মেডিকেলে ভর্তির সুযোগ পাননি। তবে উচ্চশিক্ষার অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হয়ে এবার পুনরায় মেডিকেল পরীক্ষায় অংশ নেন। এবার সাফল্য ধরা দেয়।
পরিবারের ছয় সন্তানের মধ্যে শিমা পঞ্চম। কমলনগর উপজেলার হাজিরহাট ইউনিয়নের চরজাঙ্গালীয়া এলাকার দরিদ্র বাবা আলী আহাম্মদ দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকায় আয়-রোজগার নেই। বড় দুই ভাই মো. রিপন ও জাহাঙ্গীর আলমের স্বল্প আয়ে কোনো রকম চলছে তাদের সংসার। চরকালকিনি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পর টাকার অভাবে শিমার লেখাপড়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন শিক্ষকরা তাকে সম্পূর্ণ বিনা খরচে পড়ালেখা করার সুযোগ দেন। এভাবেই দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা চলে তার। সেখান থেকে এসএসসি পাসের পর একই ধরনের সহযোগিতা পান লক্ষ্মীপুর সরকারি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়ে। সেখান থেকে এইচএসসি পাসের পর কোচিং ছাড়াই বাড়িতে বসে মেডিকেলে ভর্তির প্রস্তুতি নেন।
শিমা আক্তার জানান, দারিদ্র্য জয় করা বিভিন্ন গুণীজনের জীবনী পড়ে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছেন। এটাকে ধারণ করেই মেডিকেলে পড়ার স্বপ্ন দেখেন। প্রথমবার যখন সেই স্বপ্ন অধরা হয়ে পড়ে তখন মনে জেদ চাপে। ওই জেদই তাকে স্বপ্ন পূরণের কাছাকাছি নিয়ে যায়। এ সাফল্যের জন্য মা, ভাই ও শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে স্বপ্ন পূরণে সবার সহযোগিতা চান তিনি।  
শিমার এমন সাফল্যে খুশি তার প্রতিবেশী স্কুলশিক্ষক মিজানুর রহমান মানিক । তিনি জানান, ছোটবেলা থেকে শিমা অত্যন্ত মেধাবী ছাত্রী ছিল। শিমার পড়ালেখার জন্য তার পরিবারের সদস্যরা অনেক কষ্ট করেছেন। আজ তাদের কষ্ট সার্থক হলেও তাদের বড় চিন্তা পারিবারিক অভাব-অনটন।
চরকালকিনি আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক মাহমুদুর রহমান বেলায়েত বলেন, ‘এই বিদ্যালয়ে টাকার অভাবে পড়ালেখা শিমার বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন মেধার কথা চিন্তা করে তার পড়ালেখার সব খরচ মওকুফ করা হয়েছিল।’
কমলনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুচিত্র রঞ্জন দাস বলেন, ‘পারিবারিক অভাব-অনটনে থাকা একটি পরিবারের সদস্য হয়েও শিমা যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শিমাকে যথাসাধ্য সহযোগিতা করা হবে।’

আরও পড়ুন

×