ঢাকা শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫

ইতিহাসের দেশে

ইতিহাসের দেশে

আফসান চৌধুরী

আফসান চৌধুরী

প্রকাশ: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ | ০৬:২৭

প্রাচীন বাংলার ইতিহাস একসময় আমার বিদ্যাপাঠের প্রধান বিষয় ছিল। আমার মাস্টার ডিগ্রিটা সেই বিষয়ের ওপর। কিন্তু এমএ পাস করার পর আমি যোগ দিই “স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র প্রকল্পে”। ভাবলাম কিছুদিনের মধ্যেই ফিরব মাস্টার হয়ে। সেটা আর হয়নি। একই সঙ্গে আমি চলে যাই ইতিহাস চর্চার অন্য পরিসরে কাজকর্ম ও আগ্রহের কারণে। আমার কাছে একাত্তরের ইতিহাস চর্চার সাথে দেশপ্রেমের কোনো সম্পর্ক নেই। এটা ইতিহাস চর্চার একটি বিষয়, এটুকুই। দেশপ্রেম ভিন্ন পরিসরে প্রকাশ পেতে পারে। তবে তথ্যভিত্তিক রাজনৈতিক ভাবনা ও উদ্দেশ্যমুক্ত ইতিহাস চর্চা একমাত্র পন্থা হওয়া উচিত।  

২.

১৯৭১-এর ইতিহাসের সাথে এতদিন হেঁটেই বুঝি, অতীত নিয়ে আমাদের ধারণাগুলো বর্তমানের ভাবনা ও প্রয়োজনে নির্মাণ করি অনেক ক্ষেত্রে। আমাদের অতীত জানার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে আজকের দরকারটা। তাই অতীত জানা বা তার চেহারা আমাদের বর্তমানের চিত্র বহন করে, আমাদের এই দুই কালকে এক করে তৃতীয় কোনো পরিসর তৈরি করে। ইতিহাস সাজাই যে যার পছন্দমতো।

তবে এটা সাম্প্রতিক বিষয় নয়। এই ভাবনার সূত্র যখন থেকে আমরা ‘রাজা’ বা ‘রাষ্ট্র’ শব্দকে বলতে শিখেছি তখন থেকেই। এটার সাথে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।

৩.

প্রাচীন ইতিহাস নিয়ে আমরা সরলভাবে বলি, শশাঙ্ক, পাল, সেন, তুর্ক-আফগান শাসন ইত্যাদি। এরা সবাই ছিল আমাদের শাসককুল, কিন্তু সেই সময়ের পাবলিক কী ভাবত সেটা বলি না, কারণ আমরা জানি না। এদের অনেকের সূত্র উত্তর ভারত বা আরও দূরের রাজনীতি বা অর্থনীতি। এমনকি ‘বাংলাকে’ আমরা এই বরেন্দ্র, রাঢ় অঞ্চলে সীমাবদ্ধ করে রাখি অনেক ক্ষেত্রে। আমরা শুনি ‘বাংলার’ প্রথম স্বাধীন রাজা শশাঙ্ক। সে কে? কেন “স্বাধীন”। আগে পরাধীন থাকলে, কার অধীনে ছিলাম? আমার শুনলাম ‘মাৎস্যন্যায়’ নামের কালের কথা যখন চারিদিকে নাকি ছিল অনাচার, জিঘাংসা, মারপিট, রাজায় রাজায় খুনাখুনি, মানুষে মানুষে হানাহানি। কীভাবে জানলাম? এত রাজা এলো কোথা থেকে? পালদের নাম পেলাম লামা তারানাথ নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু যে পালদের সমর্থক ছিল তার পুঁথি থেকে। এটা কি বাংলার বাস্তব অবস্থা ছিল, না দূরের উত্তর ভারতের? সাধারণ মানুষের কথা আছে ওই বইতে? পালরা রাজা হলো কী করে? কে বানাল? অনেকদিন শুনতাম, সামন্তরা সবাই ভোট দিয়ে তাদের রাজা করে। কেউ কোনো প্রমাণ দিয়েছে? না। তারানাথ লিখেছেন, আমরা বলেছি। আমাদের এটা ভাবতে বলতে সুবিধা হয়, গর্ব হয়, তাই বলেছি। পালদের শুরুর ইতিহাস খুঁজে পাইনি বলে এটা মানতে সহজ হয়েছে অনেকের জন্য।

৪.

পালদের আমরা ভক্ত বৌদ্ধ বানালাম অথচ তারা শৈব ধর্মের বিরাট প্যাট্রন ছিল। দুইটা ধর্ম একসাথে? আরও নজির আছে? যদি থাকে তার মানে তো ধর্মের সুবিধা নেওয়া। অশোকও হয়তো তাই করেছে। পালদের কালে যে বৌদ্ধ মঠ ছিল, তাদের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল রাজাদের। সেটা ধার্মিক না রাজনৈতিক সম্পর্ক, এখনও টেক্সট বইতে পড়াই না। কিন্তু এখন গবেষকরা বলেন এটা দুই পক্ষের সুবিধার ও সুযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা। অর্থাৎ রাজনীতি ও রাজ্য চালনায় অনেক কিছু প্রয়োজন হয়, আজ হয়, তখনও হতো।

৫.

কিন্তু আরও মজার হলো যে আমরা বলতে ভুলে যাই, পাল-সেনরা ছিলেন উত্তর ভারতের রাজনীতির নিকটের বরেন্দ্র অঞ্চলে, যেটা পূর্ব ও দক্ষিণ বাংলার নয়। সেখানে দশম শতাব্দী থেকে রাজত্ব করে চন্দ্রবংশ; যাদের রাজপিতা ছিল হরিকেল রাজা, যেটা বার্মায় অবস্থিত। তাদের উপস্থিতি ছিল আরও আগে থেকে। এদের সাথে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ ছিল, উত্তর ভারতের চেয়ে। অর্থাৎ পাল-সেনরা একক বাংলার রাজা ছিল কিনা জানি না। কারণ ‘একক’ বাংলা বলে কিছু ছিল কি? লক্ষণ সেনকে কেন ‘বাংলা’ দখল করতে হলো যদি এক বাংলা হতো? অনেকগুলো ছোট ছোট অঞ্চল, রাজ্য মিলেই আজকের আমরা– যে নামেই ডাকি নিজেদের। কিন্তু আমরা আজকের ভাবনা দিয়ে বানাই গতকালের বাস্তবতা। 

৬.

আমরা প্রাচীন কাল সম্পর্কে যেসব সূত্র পাই বা ব্যবহার করি “বাংলার” ইতিহাস বর্ণনায়, তার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশ ও বিস্তার। পালদের একটি শ্ৰেষ্ঠ “বৌদ্ধ” রাজ্য বলা হয়। পণ্ডিতরা তাকে “পরম সৌগত” বলেন বা বলতেন। কিন্তু বৌদ্ধ ধর্ম তো যুদ্ধবিরোধী শান্তির ধর্ম। পালরা তো উত্তর ভারতের দখলদারি যুদ্ধের অংশীদার ছিল। রাষ্ট্রকূট, গুর্জরী প্রতিহারা ও পাল– এই  ত্রিমুখী দ্বন্দ্বের চিত্র থেকে কি প্রমাণ হয় তারা শান্তিপ্রিয় বৌদ্ধ রাজা না, যারা লড়াই দখল বেশ পছন্দ করত? এটি উত্তর ভারতের রাজনীতির অংশ হিসেবে ছিল। কিন্তু আমরা একটি শান্তিপ্রিয় উত্তর-মাৎস্যন্যায় কালের কথা নির্মাণ করেছি আমাদের অতীত নিয়ে।

৭.

পালদের তাড়িয়ে সেন বংশ আসে। উভয়ই ছিল সামন্ত চক্রের সদস্য। সেনদের বলা হয় বৌদ্ধবিরোধী ও হিন্দু বর্ণপ্রথার প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু এই দেশে স্থানীয় মানুষ তো প্রায় সবাই “হাইল্লা জাইল্লা-জোলা”, কিসিমের। তারা এককালের আর্যদের ভাষায় “অসুর”, “আর্য- আবর্তের” বাইরের মানুষ। তাদের উচ্চবর্ণের পেশা পালন কি সম্ভব? নীরদ চৌধুরীর “হিন্দুইজম” বইতে এটা নিয়ে আলাপ আছে। সেনরা এসেছিল কোথা থেকে? দক্ষিণের কর্ণাটক থেকে উত্তর ভারতের যে ক্ষমতার বলয়, তার সাথে যুক্ত হয়ে। তারা বৌদ্ধবিরোধী ছিল? কোনো প্রমাণ নেই যে তাদের সাধারণ মানুষের ধর্ম চর্চা নিয়ে কোনো ভালো-মন্দ আগ্রহ ছিল। তবে এই সমৃদ্ধ বৌদ্ধ মঠগুলো ছিল পাল সমর্থক, তাই তাদের খেদায়। তাই ভিক্ষুদের পাশের দেশে পালানো স্বাভাবিক না? এটা তো দীর্ঘদিনের পন্থা ক্ষমতা বদল হওয়ার, তাই না? সাথে নিয়ে গেল যেটা তাদের সবচেয়ে কাজে লাগে, যেন নেপালে গিয়ে তাদের ইজ্জত থাকে; ধর্ম গ্রন্থসমূহ। সেসবের মধ্যে একটি হচ্ছে “চর্যাপদ”।

৮.

তাহলে বাংলা ভাষার সাংস্কৃতিক সূত্র হচ্ছে তন্ত্র যেহেতু চর্যাপদ হচ্ছে তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের মন্ত্র-গানের সংকলন। তাহলে কি পাল যুগের মঠগুলো তান্ত্রিক ছিল? কিন্তু এই ধর্ম ভাবনার সূত্র কী? তান্ত্রিক হিন্দু ধর্ম। আর সেই ভাবনার অন্যতম সূত্র কী? বৈদিক হিন্দুপূর্ব মানুষের আদি ধারণাসমূহ? তাহলে শুরু কই? আসলে সব ভাবনায় ধারাবাহিকতা আছে, কোনোটাই হঠাৎ করে হয় না। পরম্পরায় ইতিহাস হয়। তবে কেবল ভিক্ষু আর ব্রাহ্মণ লিখতে পড়তে জানত, সাধারণ মানুষ নয়। তারা পালন করত, যার যেটা সুবিধা। সে পাল এলো না গেল, সেন এলো না গেল, তাতে তার এমন কোনো মাথাব্যথা ছিল, এর  কোনো প্রমাণ এখনও মেলেনি কোনো সূত্রে। 

তাহলে এতসব আদি ইতিহাস, বিশ্বাস, তত্ত্ব, রাজ্য দখলের মধ্যে পাবলিক আছে? পাবলিকের ভূমিকার ধারাবাহিকতা কী? তখনকার হোক বা এখনকার? 

কথাসাহিত্যিক, গবেষক

আরও পড়ুন

×